হোম > ছাপা সংস্করণ

দুর্নীতি কি সহজে দূর হয়?

জাহীদ রেজা নূর

গত শতাব্দীর একটা বড় সময়জুড়েই পৃথিবীর নানা দেশে ক্ষমতা পরিবর্তন হতো অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। ক্ষমতায় আসতেন কোনো জেনারেল। তিনি ঘোষণা করতেন, দেশ দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে বলে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করছেন। শুরুর দিকে সাধারণ মানুষ খুব খুশি হতো। ভাবত, সত্যিই এবার দুর্নীতিহীন একটা নতুন জীবনের 
আস্বাদ পাওয়া যাবে।

সেই ক্ষমতা দখলকারী জেনারেল সাধারণ জনগণকে আশ্বস্ত করে বলতেন, কিছুদিনের জন্য ক্ষমতায় বসেছেন, দেশে সবকিছু সিস্টেমের মধ্যে আনতে পারলেই তিনি জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবেন।

কিন্তু এরপর জনগণের অভিজ্ঞতা হতো ভিন্ন। তারা দেখত, সেই যে জেনারেল সাহেব ক্ষমতায় এলেন, তারপর আলমারিতে উর্দি উঠিয়ে রেখে রাজনৈতিক দল গঠনের দিকে মনোযোগ দিলেন। বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড কঠোর হাতে দমন করলেন এবং দেশের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে বসলেন। আর দুর্নীতি? চলতে থাকল বহাল তবিয়তে। 
শুধু জেনারেলরাই নন, অনেক রাজনৈতিক দল বিপুল ভোটে জয়লাভ করে একই ঘোষণা দিয়েছে এবং একসময় দুর্নীতিকে করেছে চলার সাথি।

গত শতাব্দীতে প্রবলভাবে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বহু দেশ যখন বের হলো, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, নিজ হাতে ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণের ভার আসার পর এই দেশগুলোর ভাগ্যের পরিবর্তন হবে। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, নিজ দেশের নিয়ন্ত্রকেরা নিয়ন্ত্রণহীনভাবে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠেছেন। রক্ষক হয়ে উঠেছে ভক্ষক। 

আমাদের দেশ দুর্নীতিবাজ দেশের তালিকার ঠিক কোন জায়গায় আছে, তা খুঁজে নেবেন। দেখতে পাবেন, বহুদিন ধরেই আমরা সেরা দুর্নীতিবাজদের তালিকায় পোক্ত আসন নিয়ে বেঁচে আছি। আমাদের সরকারি অফিসগুলোর ইঞ্জিনে তেল দেওয়া না হলে ‘গাড়ি চলে না, চলে না, চলে নারে, গাড়ি 
চলে না...।’

বহুভাবে আমাদের দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ চলেছে। এমনকি ইদানীং ধর্মব্যবসায়ীরা এ দেশটাকে মুসলমানদের দেশ বলে গলা ফাটিয়ে দিচ্ছে, কিন্তু বীরপুঙ্গবেরা কীভাবে ঘুষ খাচ্ছে, সেটা তো যে কেউ দেখতে পাচ্ছে। তবে আক্ষেপ হলো, আমাদের দেশে চুনোপুঁটিরা ধরা পড়ে বেশি। মাঝারি আর উচ্চমাপের দুর্নীতিবাজেরা সব সময়ই থাকে আড়ালে। রাশিয়ায় একটা কথা চালু হয়ে গেছে ইদানীং।

লুকিয়ে বলা হচ্ছে, ‘যারা বড় দুর্নীতিবাজ, তারা আইন প্রণয়ন করে, যারা মাঝারি, তারা সে আইন বাস্তবায়নের কাজে নিযুক্ত হয় আর বড়শিতে ধরা পড়ে চুনোপুঁটিরা। দুর্নীতির ব্যাপারে আমাদের দেশ আর রাশিয়া অনেকটা একই ময়দানে যুদ্ধরত।

একটু খেয়াল করলেই দেখবেন, কোনো সরকারি কেরানি বা ড্রাইভার কয়েক কোটি টাকা লোপাট করে ধরা পড়ায় পত্রপত্রিকায় সে কী প্রচার! মনে হয়, দেশের সব সম্পদ এই লুটেরারাই ধ্বংস করে দিলেন। কিন্তু আরেকটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, তাঁদের চেয়ে একটু উঁচু স্তরের দুর্নীতিবাজদের ধরার কাজটা কেউ করে না। হাজার কোটি টাকা লোপাট করে দেন যাঁরা, তাঁদের নিয়ে না সরকার, না মিডিয়া কেউই সোচ্চার হয় না। 

কেন হয় না, সেটাও অনেকে জানে। কিন্তু তাঁরা কী কারণে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারেন, সে ব্যাপারেও বোধ হয় এখন সাধারণ মানুষ জানে।

দুই. রুশ ভাষার শিক্ষক হিসেবে কয়েক বছর আগে রাশিয়ায় গিয়েছিলাম। সেখানে একজন রুশ শিক্ষকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। অবসরে দুর্নীতি বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তিনি নিজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক হওয়ায় দুর্নীতির নানা কথা তাঁর নখদর্পণে।

আমি ছিলাম মূলত শ্রোতা। তিনিই বলেছিলেন, আমাদের মতো দেশগুলোয় আপাতদৃষ্টিতে যে মানুষদের দিকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে তাকানো হয়, তাঁদের সবার মধ্যে সততা, মানবিকতা খুঁজে লাভ নেই। তিনি আরও বলেছিলেন, সেলিব্রেটিদের দূর থেকে দেখাই ভালো। কাছে গেলে হতাশ হতে হয়।

এ কথাগুলো ছাড়াও তিনি যা বলেছিলেন, সেগুলো এখনো সস্তা হয়ে যায়নি। বর্তমানের নিরিখে মনে হয়, সে কথাগুলো কেন এখনো আমরা মাথার মুকুট করে রেখেছি? 

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ যে লড়াইটা করে থাকে, সেগুলো অল্পবিস্তর আমাদের জানা। তারপরও একটু পৃথিবী ঘুরে দেখা যাক, কোথায় কীভাবে যুদ্ধটা হচ্ছে।

চীনে ঘুষ খাওয়াকে বড় অপরাধ হিসেবেই দেখা হয়। ২০১৭ সালে যখন রুশ শিক্ষক কথাগুলো বলছিলেন, তখন চীনে ঘুষ খাওয়া ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি আত্মসাতের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। বছরে কয়েক হাজার মানুষ ঘুষ ও রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি দখলের শাস্তি পেত। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, এরপরও অনেকেই ঘুষ খাওয়ার লোভ সামলাতে পারত না।

সেখানে বড় বড় আমলা, বড় বড় প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজাররাও ঘুষ নেওয়ার দায়ে শাস্তি পেতেন, তারপরও লুকিয়ে-চুরিয়ে ঘুষ খাওয়া চলত। চীন সরকার আইন করেছে, সরকারি কর্মচারীরা উপহার হিসেবে স্টক এক্সচেঞ্জের কোনো শেয়ার নিতে পারবেন না, রহস্যজনক কম দামে কোনো স্থাবর সম্পত্তি কিংবা গাড়ি কিনতে পারবেন না, সরকারি চাকরিজীবন শেষে বড় কোনো কোম্পানিতে চাকরি করতে পারবেন না।

সে দেশে সামাজিক শিক্ষার ব্যবস্থা আছে। ঘুষের লোভ সংবরণের জন্য নানা ধরনের কোর্স করতে হয়। এত কিছুর পরও দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় চীন রয়েছে। মানুষের লোভ কতটা থাকলে কঠোর আইনের ফাঁক দিয়েও কর্মচারীরা ঘুষ খান!

তিন. দুর্নীতিতে হাবুডুবু খাওয়া হংকং বেছে নিয়েছিল অন্য আরেকটি পথ। তবে সে পথে চলতে হলে মনে সততা আর দেশপ্রেম থাকা দরকার। হংকংয়ে প্রথমেই সরকারি আমলাদের প্রমাণ করতে হয়েছে তাঁদের গাড়ি, বাড়ি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সৎভাবে উপার্জিত টাকায় কেনা হয়েছে। অস্বচ্ছ আয় দিয়ে সম্পত্তি করার প্রমাণ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গে জেলে পোরা হয়েছে সরকারি কর্মচারীকে। কিংবা সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

দ্বিতীয়ত, সরকারি কর্মচারীদের বেতন এমন একপর্যায় পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যেন তিনি নিজের বেতনেই স্বচ্ছন্দে চলতে পারেন। তাঁর যেন ঘুষের টাকার প্রয়োজন না হয়। তৃতীয়ত, সেখানে ঘুষের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে তোলার নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ মানুষ প্রকাশ্যে ঘুষখোরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে পারে, গণমাধ্যম লিখতে পারে। দেশের নাগরিকেরা এখন বিশ্বাস করে, সরকার সত্যিই ঘুষখোরদের কঠোর শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশটি রাতারাতি এখন দুর্নীতিমুক্ত দেশের মডেল হয়ে উঠেছে।

সিঙ্গাপুরের কথা তো বহু আলোচনাতেই উঠে আসে। আদালতকে অনেক বেশি স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে সেখানে। ফৌজদারি আইনের প্রয়োগ জোরদার করা হয়েছে। বিচারকদের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। ঘুষের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছে দেশ। সেখানে একটি নিয়ম আছে। যদি কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ ওঠে, তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে না পারেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি অপরাধী হিসেবে গণ্য হন। এখন সবাই জানে, সিঙ্গাপুর দুর্নীতির বিচারে পৃথিবীতে কোন অবস্থানে আছে।

দক্ষিণ কোরিয়ার কোনো নাগরিক যখন কোনো সরকারি দপ্তরে আবেদন পাঠায়, তখন তা উন্মুক্ত থাকে। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে একজন সরকারি কর্মচারী কত দিনে কাজটি করে থাকেন, তা জানা হয়ে যায় সবার। তাই এই মুক্ত পরিবেশে চাইলেই একজন সরকারি আমলা বা কর্মচারী সাধারণ নাগরিককে অযথা ঘোরাতে পারেন না। যদিও সিঙ্গাপুর ও হংকংয়ের চেয়ে দক্ষিণ কোরিয়া দুর্নীতি দমনে পিছিয়ে আছে, কিন্তু তারপরও সরকারি অফিসের কাজে গতি আছে সে দেশে।

চার. আমার এক বন্ধু প্রায়ই সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউ আর সোভিয়েত ইউনিয়নের স্তালিনের কথা বলে। কঠোর হাতে দেশ চালালে একসময় এই দুর্নীতিবাজেরা কুপোকাত হবে বলে সে বিশ্বাস করে। কিন্তু আমি কেন যেন ওর কথায় ভরসা রাখতে পারি না। স্তালিনের কঠোরতা অনেক সময়ই মানবতার বিপরীতে গেছে বলে আমার মনে হয়, আর লি কুয়ান ইউ যে দেশটি চালিয়েছেন, যাঁদের তিনি পাশে পেয়েছেন, তাতে একটা বড় পরিবর্তন আনতে পেরেছেন। আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রক্ষককে ভক্ষকের ভূমিকায় দেখা যায়। যাঁর হাতে থাকবে বিচারের ভার, তিনিই দেখা যাবে গণেশ উল্টে দিয়েছেন। একেবারে শিশুকাল থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সচেতন না হলে দুর্নীতিবাজদের টুঁটি টিপে ধরা যাবে না।

শিক্ষক পিতাকে কায়ক্লেশে জীবনযাপন করতে দেখা সন্তান যখন দেখে, ঘুষখোর কর্মকর্তা হাইব্রিড গাড়িতে করে মহা ফুর্তি করে বেড়াচ্ছেন, তাঁর কোনো সাজা হচ্ছে না, তখন সে কোন পথ বেছে নেবে? গরিবানা সততার পথ, নাকি বিচার বিহীনভাবে হাওয়ায় উড়তে থাকা ঘুষখোরের পথ? 
প্রশ্নটির উত্তর কিন্তু সহজ নয়।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ