হোম > ছাপা সংস্করণ

মুর্মুর নিয়োগকে খাটো করার অবকাশ নেই

শাহানা হুদা রঞ্জনা

ভারত কোনো স্বর্গরাজ্য নয় বা কোনো কল্যাণমূলক আধুনিক রাষ্ট্রও নয়। অসংখ্য সীমাবদ্ধতা ও নেতিবাচকতার মধ্যেও একজন আদিবাসী সাঁওতাল নারী ভারতের রাষ্ট্রপতি হওয়ায় আমরা আনন্দিত হয়েছি। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে এবং তাঁর উঠে আসার প্রক্রিয়াকে অভিনন্দন জানাই।

অনেকে অবশ্য এটাকে শুধু বিজেপির রাজনৈতিক চাল হিসেবে দেখছেন। বলছেন দ্রৌপদী মুর্মুও তো ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানই দেবেন। বিজেপি যখন তাদের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবে, তখন তো তিনি সেই দলের নেতা বা নেত্রীই হবেন। এখানে আলাদা কোনো হিসাব তো হবে না। কিন্তু আমি আমাদের দেশের এবং বিশ্বের আরও অনেক দেশের পরিপ্রেক্ষিত থেকে এই নিয়োগটিকে দেখতে চাইছি।

এটা বিজেপির রাজনৈতিক চাল হলেও ১২০ কোটির বেশি মানুষের দেশ ভারতে একজন আদিবাসী নারীর রাষ্ট্রপতি নির্বাচন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। শুধু কি জনসংখ্যা? ভারতে এখনো জাত-পাত প্রথা ও বর্ণবৈষম্য প্রবল। সেখানে দলিত, হরিজন, শূদ্র, আদিবাসীসহ মুসলিমরা নিপীড়ন-নির্যাতনের মধ্যে রয়েছেন। সেই সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে এই ঘটনা বিশ্বব্যাপী আদিবাসীদের অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নকে সামনে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমার বিশ্বাস।

আচ্ছা বাংলাদেশ কি একজন সাঁওতাল বা গারো, হাজং, চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা বা তঞ্চঙ্গ্যা, ম্রো বা দলিত-হরিজনকে রাষ্ট্রপতি বানাতে পারবে? পাকিস্তান কি একজন গিলগিট বা বালুচকে প্রেসিডেন্ট বানাবে? এখনো একজন ম্রো ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলে খবর হয় আমাদের দেশে।

তৃতীয় বিশ্বে তো বটেই, নারীরা এখনো বিশ্বের অনেক দেশেই সমমর্যাদার অংশীদার নয়। আমাদের দেশের মতো ভারতেও নারীর অবস্থান প্রান্তিক। আদিবাসীদের অবস্থান আরও প্রান্তিক। সেই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একজন নারীর অবস্থান আরও কতটা পেছনে, তা সহজেই অনুমেয়। দ্রৌপদী মুর্মু সেই কয়েকটি প্রান্তিকতা ডিঙিয়ে ক্ষমতায়িত হয়েছেন। তাঁকে রাষ্ট্রপতি করার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য যা-ই হোক, বাস্তবতা হচ্ছে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাহীন মানুষদের একজন হয়েও বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপতি।

ঊনবিংশ শতকে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর শহীদ সিধু-কানু-চাঁদ-ভৈরবের উত্তরসূরি এই দ্রৌপদী মুর্মু। জাতি, ধর্ম, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের দেশ ভারতের আছে বহুত্ববাদী উদার গণতন্ত্র। নতুন রাষ্ট্রপতি তাঁর নিজের আদিবাসী দলিত জনগোষ্ঠীসহ ধর্ম-মতনির্বিশেষে সব ভারতীয়ের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

ভারত ও বাংলাদেশে আদিবাসী নারী বঞ্চনা ও নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছে। আদিবাসী নারীদের ওপর বৈষম্য ও সহিসংতা এখনো কমেনি বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেড়েছে। এর পাশাপাশি আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নীতি ও আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, ন্যায্য বিচারের অভাব, শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসরতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি ইত্যাদিও এসব সহিংসতা বৃদ্ধির কারণ।

আমরা বাংলাদেশে দেখে আসছি জাতীয় নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠানে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নারী নেই, নেই দলিত-হরিজন প্রতিনিধিত্ব। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও আদিবাসী/দলিত-হরিজনরা খুবই কম অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়ে থাকে। বৈষম্যমূলক নীতি এবং সমাজের বিদ্যমান পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে আদিবাসী নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত রাখা হয় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, চাকরি প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তারা খুব কমই সুযোগ পেয়ে থাকে।

অনেকে বলছেন, দ্রৌপদী মুর্মু পুতুল রাষ্ট্রপতি হবেন। সত্যি করে ভেবে বলুন তো, সংসদীয় সরকারের অধীনে কোনো রাষ্ট্রপতি তাঁর সর্বময় ক্ষমতা দেখাতে পারেন? অধিকাংশ রাষ্ট্রপতিই মূলত সরকারের হয়েই কাজ করেছেন। যে যখন কেন্দ্রে শাসকের আসনে থেকেছে, রাষ্ট্রপতিকেও তাঁদের অনুগ্রহ মেনেই কাজ করতে হয়েছে। যদিও সংবিধানমতে, দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক রাষ্ট্রপতির পদ। প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা থেকে সরকার ভেঙে দেওয়া, সব অধিকারই ন্যস্ত থাকে তাঁর হাতে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি এগুলোর ব্যবহার করতে পারেন কতটুকু?

দ্রৌপদীর পথচলাটা কিন্তু সাধারণ একজন নারীর চেয়েও অনেক কঠিন ছিল। তাঁকে রীতিমতো যুদ্ধ করে, নিজের শক্তির প্রকাশ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে আসতে হয়েছে। ভারতের মতো একটি দেশে দলীয় রাজনীতিটাও যথেষ্ট চ্যালেঞ্জিং। চাইলেই কেউ হুট করে এসে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী বা দলনেতা হতে পারেন না।

এর মধ্যে যদি কেউ প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে উঠে আসা প্রান্তিক নারী হন, তাহলে সেই যুদ্ধ আরও কঠিন হয়। এ নিয়ে টুইটারে একটি বিবৃতিও দিয়েছেন মোদি। এতে তিনি বলেছেন, ‘লাখ লাখ মানুষ, বিশেষ করে যাঁরা দারিদ্র্য এবং কষ্টের সম্মুখীন হয়েছেন, তাঁরা শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মুর জীবন থেকে শক্তি লাভ করবেন। নীতিগত বিষয়ে তাঁর বোঝাপড়া এবং সহানুভূতিশীল প্রকৃতি আমাদের দেশকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করবে।’

বিজেপির রাজনীতির সঙ্গে, মতাদর্শের সঙ্গে আমাদের মতো অনেকেরই যোজন যোজন পার্থক্য আছে। আমরা তাদের রাজনীতি পছন্দও করি না। কিন্তু একজন আদিবাসী নারীকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করার মাধ্যমে বিজেপি যে রাজনীতির খেলায় এগিয়ে গেছে কয়েক ধাপ, তা স্বীকার করতেই হবে। ২০১৭ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিহার রাজ্যের গভর্নর ও দলিত সম্প্রদায়ের রামনাথ কোবিন্দকেও মনোনয়ন দিয়েছিল বিজেপি।

৬৪ বছর বয়সী দ্রৌপদী ভারতের ওডিশা রাজ্যের একটি সাঁওতাল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রাজনৈতিক জীবনে দ্রৌপদী এর আগে ওডিশার মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর দক্ষতার জোরেই বোর্ড ২০ জনের নাম নিয়ে আলোচনার পর এই আদিবাসী নারীকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

একজন আদিবাসী নারী হিসেবে দ্রৌপদী মুর্মু জানেন যে সে দেশের আদিবাসী এবং অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে, বিশেষ করে প্রান্তিক নারীকে, কতটা প্রতিকূল অবস্থার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। দ্রৌপদীর ভারতেই ১০ লাখের বেশি আদিবাসী এবং অন্যান্য জনজাতি পরিবারের মাথায় তাদের বনভূমির আবাসস্থল থেকে উচ্ছেদের নোটিশ ঝুলছে। নিরক্ষর বনবাসী পরিবারগুলোর পক্ষে ওই সংক্রান্ত নথিপত্র জোগাড় করা সম্ভব না হওয়ায়, তাদের জমির মালিকানাস্বত্ব খারিজ হয়ে যায়।

বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মোদি সরকারকে এ জন্য দায়ী করে আসছে। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মনে করেন, এ বিষয়ে মোদি সরকার আগাগোড়া নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে। এতে বোঝা যায়, আদিবাসী ও জনজাতিদের প্রতি সরকার কতটা নির্বিকার। লাখ লাখ গরিব আদিবাসী কৃষিজীবী পরিবার তাদের চিরাচরিত বাসভূমি থেকে উৎখাত হলে মোদি সরকারের কিছু যায় আসে না।

উল্লেখ্য, ভারতে প্রায় ৪ কোটি হেক্টর বনভূমিতে বসবাস করে ১০ কোটি আদিবাসী ও অন্যান্য জনজাতি। এদের উচ্ছেদ করার পেছনে কারণ হলো, খনি ও কলকারখানা প্রতিষ্ঠা। আদিবাসীদের বনভূমি আবাস কেড়ে নিয়ে খনি হয়েছে, বাঁধ হয়েছে, কারখানা হয়েছে। তারা পেয়েছে শুধু অবিচার আর বঞ্চনা।

যে মানুষগুলো শত শত বছর ধরে বেঁচেই আছে শুধু অরণ্যকে ঘিরে, যাদের বসবাস, জন্ম, মৃত্যু, সংস্কৃতি, আনন্দ, বেদনা সব এই প্রকৃতিকে ঘিরে, সেই মানুষগুলোকেই আধুনিকতার নামে, বিনোদনকেন্দ্রের নামে সমাজের মূলধারার মানুষেরা উচ্ছেদ করে চলেছে, যে পাহাড় ও বনকে আদিবাসী মানুষ নিজেদের ঐতিহ্য বলে মনে করে, ক্রমেই রাষ্ট্র তা কেড়ে নিচ্ছে নানা কায়দায়। তাদের সঙ্গে কোনো কথা না বলে যাকে ইচ্ছা তাকেই জমির অধিকার দিয়ে দিচ্ছে। 

ভারতের নতুন রাষ্ট্রপতি কীভাবে উপেক্ষা করবেন বা অস্বীকার করবেন আদিবাসী, দলিত-হরিজনসহ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের চলমান উপেক্ষাকে? হয়তোবা দ্রৌপদী মুর্মুর সামনে এটাই একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আসতে পারে। একদিকে বিজেপির রাজনৈতিক ইচ্ছা পালন, অন্যদিকে নিজের নির্যাতিত, নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠীকে নতুন জীবনদান। এরপরও আমরা 
গাইতে চাই,

‘যদি বলো চাইছি নেহাত, চাইছি নেহাত স্বর্গরাজ্য
আমি চাই একদিন হবে, একদিন হবে এটাই গ্রাহ্য।’ 

লেখক: সিনিয়র কো-অর্ডিনেটর, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ