আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানার সম্পত্তি আত্মসাৎ এবং প্রতিষ্ঠানটিকে কুক্ষিগত করে রেখেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এদিকে চক্রটির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করারও জো নেই কারও। প্রতিবাদ করলেই হুমকি, হয়রানিমূলক মামলাসহ বিভিন্নভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ।
এমনকি সিন্ডিকেটটি এতিমখানার ভেতরে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে এতিমখানার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নুসরাত, কম্পিউটার অপারেটর আকতার, মালি আবদুর রহিম ও দারোয়ান জাকিরকে দিয়ে ভয়ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তাঁরা কর্মচারী হয়েও সিন্ডিকেটের ক্ষমতাবলে থাকেন কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দকৃত বাসায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০৪ সালে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা পরিচালনা কমিটির সভাপতি ছিলেন বিএনপির সাবেক সংরক্ষিত মহিলা সাংসদ বেগম শামসুন্নাহার আহসানুল্লাহ। তাঁর ছেলে খাজা জাকি আহসানুল্লাহ সানি ছিলেন সহসভাপতি এবং আনিসুর রহমান ছিলেন কার্যকরী সদস্য। তাঁরা এতিমখানার উন্নয়নের নামে দুই বিঘা জমি ডেভেলপার কোম্পানির কাছে চুক্তিতে দেন। এই চুক্তি এতিমখানার স্বার্থবিরোধী দাবি করে চার শিক্ষার্থী হাইকোর্টে রিট করেন। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এতিমখানার জমির ওপর নির্মিত ভবন বাজেয়াপ্ত করে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। ভবনটি বাজেয়াপ্ত হওয়ায় রিট করা ছাত্রদের নামে হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে জেল খাটানো হয়। এ বিষয়ে আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমরা দায়িত্বে ছিলাম ১০ বছর আগে। এখন প্রতিষ্ঠানটি প্রশাসকের অধীন থাকায় এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই আমাদের।’
কম্পিউটার অপারেটর আকতার, মালি আবদুর রহিম ও দারোয়ান জাকির এতিমখানার গলিতে রিকশার গ্যারেজ, চায়ের দোকান ও দুধের গাড়ি রাখার জায়গা ভাড়া দিয়েছেন। এসব দোকানে এতিমখানার পানি ও বিদ্যুতের অবৈধ সংযোগও দিয়েছেন তাঁরা। এসব বিষয়ে মালি আবদুর রহিম বলেন, ‘বিভিন্ন দোকান ও রিকশার গ্যারেজগুলো এমনিতেই গড়ে উঠেছে।’ এ ছাড়া এতিমখানার ভেতরেই দারোয়ান জাকিরের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে মাদক সিন্ডিকেট। এতিমখানা মার্কেটের ৩০টি দোকান চুক্তি করিয়ে কয়েক লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কম্পিউটার অপারেটর আকতার।
এতিমখানা মার্কেটের ভাড়াটিয়া তসলিম হোসেন বলেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাঁরা মামলা দেওয়ার হুমকি ও ভয়ভীতি দেখিয়ে ১৪ দিন দোকান বন্ধ রাখেন। এতে প্রায় সাত লাখ টাকার কাঁচামাল নষ্ট হয়েছে। পরে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নুসরাত ডোনেশন স্লিপের মাধ্যমে জোরপূর্বক ৩০ হাজার টাকা নিয়ে দোকান খুলে দেন।
এদিকে ২০২০ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. কামারুজ্জামানকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয় ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. রকনুল হক ও ইউসিডি-৫-এর সমাজসেবা অফিসার মো. জহির উদ্দিনকে। সে বছরেই তাঁরা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে দেড় কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা ছাড়াই হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে নুসরাত আলম, সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে মো. শাকিল এবং আবাসিক শিক্ষক (মহিলা) পদে আয়েশা খাতুনসহ ছয়জনকে নিয়োগ দেন। তাঁরা সবাই মো. কামারুজ্জামানের এলাকা রাজশাহী অঞ্চলের। তখন নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বজনপ্রীতির অভিযোগে হাইকোর্টে রিট করেন এতিমখানার সাবেক দুই শিক্ষার্থী। এরপর হাইকোর্ট রুল জারি করে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মো. কামরুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রশাসক নিয়োগ করেন। সেই সঙ্গে পর্যবেক্ষণে ওই নিয়োগ নতুন করে দেওয়ার কথা বলেন। নতুন প্রশাসক দায়িত্ব নিয়ে তত্ত্বাবধায়কসহ নিয়োগ পাওয়া সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মো. শাকিল ও প্লাম্বার নয়নকে বরখাস্ত করেন। কিন্তু হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নুসরাত আলম, উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আশিকুর রহমান, ট্রেড ইনস্ট্রাক্টর মোছা. পারভীন বেগম ও আবাসিক শিক্ষক (মহিলা) আয়েশা খাতুন এখনো চাকরিতে বহাল রয়েছেন।
এদিকে এতিমখানার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক মো. কামারুজ্জামান, ঢাকা জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. রকনুল হক ও ইউসিডি-৫-এর সমাজসেবা অফিসার মো. জহির উদ্দিনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এসব অভিযোগের বিষয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আমি দায়িত্ব পাওয়ার পরই তত্ত্বাবধায়কসহ কয়েকজনকে বরখাস্ত করেছি। খোঁজ নিয়ে অন্য বিষয়েও ব্যবস্থা নেব।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’