দিন যত যাচ্ছে, রাজনীতির মাঠ যেন তত গরম হয়ে উঠছে। সাধারণ মানুষের মনোযোগ এখন সেভাবে রাজনীতির দিকে নেই। কারণ, বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় মানুষ হিমশিম খাচ্ছে হিসাব মেলাতে। আয় বাড়ার কোনো লক্ষণ নেই, কিন্তু প্রতিদিনই ব্যয় বাড়ছে। শুধু চাল, ডাল, তেল নয়, যা কিনতে যাওয়া যায় সব জিনিসেরই দাম বেশি।
সাবান থেকে শুরু করে কাগজ-কলম—কিছুই মূল্যবৃদ্ধির বাইরে নেই। যাঁদের আয়-রোজগার অঢেল, যাঁরা বেতনের থেকেও উপরি আয় করেন অধিক, তাঁদের কোনো সমস্যা নেই। তাঁদের দেশের নামডাকওয়ালা শপিং মল কেন, কেনাকাটা করতে বিদেশে যেতেও দুবার ভাবতে হয় না। কিন্তু এমন মানুষের চেয়ে দেশে তো সেই সব মানুষের সংখ্যা বেশি, যাঁদের আয় সীমিত এবং খুবই কম। এমনকি কুড়ি হাজার টাকা মাইনে যাঁর, তাঁর পক্ষেও কি চারজনের পরিবার নিয়ে আরাম করে দিন যাপন সম্ভব হচ্ছে?
এমন অসংখ্য মানুষ আছেন যাঁরা বুঝতে পারছেন না, কোন খরচটা কমিয়ে সংসারের বেহাল অবস্থা সামাল দেবেন। একেবারে মোটা চালেরও যে দাম তাতে অনেক পরিবারই পেটপুরে ভাত কত দিন খেতে পারবেন, তা ভাবতে শুরু করেছে। শুধু ভাত তো আর খাওয়া যায় না। আগে যাঁদের প্রতি বেলায় ভাতের সঙ্গে ডাল, ভাজি ও একটি তরকারির পদ থাকত, তাঁরা এখন তরকারির পদ কমিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। ডিমের দাম বেড়ে আবার কমতে শুরু করেছিল। এখন আবার বেড়েছে। সকালে নাশতার সঙ্গে ডিম খাওয়ার অভ্যাস যাঁদের ছিল, তাঁরা এটা আর বজায় রাখতে পারছেন না। মাছ-মাংস খাওয়া ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে। শিক্ষার উপকরণ, যাতায়াত খরচসহ নানামুখী ব্যয় বাড়ার চাপে সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়েছে কত পরিবার, সে খবর কি কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতাদের কাছে আছে?
সীমিত আয়ের মানুষ ও চাকরিজীবীরা বাজারের অস্থিরতায় এতটাই অসহায় অবস্থায় পড়েছেন যে চিকিৎসা কিংবা অন্য কোনো বিপদে পড়লে তাঁরা খরচ করতে পারছেন না। এমনকি বিয়েশাদির দাওয়াত পেলেও কেউ কেউ আতঙ্ক বোধ করেন। মূল্যবৃদ্ধির এই পরিস্থিতি কত দিন চলবে, তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে দীর্ঘদিন এমনটা চলতে থাকলে গণ-অসন্তোষ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এসব বিষয় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বিবেচনায় আছে কি?
দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা অনেক, তবে প্রধান দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায়। দলটি মনে করে, তারা ক্ষমতায় থাকায় দেশের বিরাট উন্নতি হয়েছে। অনেক উন্নতি দৃশ্যমানও। মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বেড়েছে। এসব যেমন অস্বীকার করা যাবে না, তেমনি এটাও ঠিক যে দেশে এই সময়কালে ধনী-গরিবের বৈষম্যও অনেক বেড়েছে। দেশে ‘মোটা আলী’ ও ‘চিকন আলী’দের পাশাপাশি অবস্থান বেমানান হলেও তা এড়ানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একই দলের সরকার বহু বছর টানা ক্ষমতায় থাকলে নানা ধরনের খারাপপ্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাম জোটের ৩৪ বছরের শাসন তার বড় উদাহরণ। ক্ষমতাসীনদের অনুগত সুবিধাভোগী শ্রেণি গড়ে ওঠে। ঘুষ-দুর্নীতির মাত্রাও বাড়ে। বাংলাদেশে এখন এ সবই হয়েছে। পাওয়ার দল ও না-পাওয়ার দল পরস্পর মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের জন্য এখন বিরোধী দল যতটা না চাপের, তার চেয়ে বেশি চাপ তৈরি করছে নিজ দলের না-পাওয়া বা বঞ্চিত পক্ষ। যেকোনো নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি তার প্রমাণ।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সাম্প্রতিক এক বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে দলের ভেতরে ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ বাড়ছে।
আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিদের সতর্ক করে দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘যাঁরা যেখানে অপকর্ম করছেন, সব তথ্য কিন্তু নেত্রীর কাছে আছে। সবার এসিআর আছে।
সময়মতো টের পাবেন। কেউ কেউ টের পাচ্ছেন, বাকিরা সামনে পাবেন।’ কিছু কিছু জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে জমিদারি করছেন দাবি করে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আপনাদের শেখ হাসিনা কোনো দিনই ক্ষমা করবেন না। জনপ্রতিনিধি জমিদারির মানসিকতা নিয়ে শেখ হাসিনার দলে থাকতে পারে না, বঙ্গবন্ধুর দলে থাকতে পারে না।’
সংগঠনের যাঁরাই অপকর্ম করে সরকারকে বিব্রত করছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দিয়ে কাদের বলেছেন, ‘আপনাদের কাছে অনুরোধ রইল, এত অর্জন, উন্নয়ন শেখ হাসিনার; দু-চারজনের অপকর্মের জন্য যেন ম্লান না হয়।’ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের পরিচয় দিয়ে অপকর্ম করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কোনো অপরাধীকে আওয়ামী লীগ ছাড় দেবে না। অপকর্মকারীদের জন্য সাফল্য ম্লান হতে পারে না। দোষ করে গুটিকয়েক, দোষ হয় পুরো সরকারের, এটা আমরা হতে দেব না।’
ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য যতটা উৎসাহী বা আশাবাদী করে তোলে, বাস্তব পরিস্থিতি আসলে ততটাই হতাশাজনক।
সরকার কতটা দোষমুক্ত আছে, নির্বাচিত হয়ে যাঁরা জায়গায় জায়গায় জমিদারি কায়েম করেছেন এবং ইতিমধ্যেই যাঁরা ‘অপরাধী’ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, তা কিন্তু স্পষ্ট নয়।
দুই.মানুষের সমস্যা নিয়ে রাজনীতিবিদদের মুখে কোনো কথা নেই। তাঁরা কথা বলেন নিজেদের নিয়ে। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা কৌশল আঁটছেন কীভাবে আরও এক মেয়াদের জন্য ক্ষমতা নিশ্চিত করা যাবে। আর ক্ষমতার বাইরে যাঁরা, তাঁদের সব মনোযোগ কীভাবে ক্ষমতা ফিরে পাওয়া যাবে, তার কলাকৌশল নির্ধারণে। বাজারে পণ্যের মূল্য ক্রমাগত কেন বাড়ছে, এর কোনটা স্বাভাবিক, কোনটা কৃত্রিম—তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর বড় নেতাদের মুখে তেমন কোনো কথা শোনা যায় কি?
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রতিদিন বিএনপির বিরুদ্ধে বলছেন। বিএনপির আন্দোলনের ক্ষমতা নেই, বিএনপি হাঁটুভাঙা দলে পরিণত হয়েছে, বিএনপির আন্দোলনের হুঁশিয়ারিকে আমলে নিচ্ছেন না। বিএনপিকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘সোজা কথা, সোজা পথে আসুন, নির্বাচনে আসুন। পৃথিবীর অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও নির্বাচন হবে। নির্বাচনের সময় সরকার রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। আর আইন প্রয়োগকারী সব সংস্থা নির্বাচন কমিশনের অধীনে থাকবে। সরকার না থাকলে কারা চালাবে দেশ? আপনাদের হাতে দেব?’
কম যান না বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও। তিনিও প্রতিদিন কথা বলেই যাচ্ছেন। যেমন গত ২৯ সেপ্টেম্বর এক সমাবেশে ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেছেন, ‘ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন বিএনপির নাকি হাঁটু ভাঙা। বিএনপির যে হাঁটু ভাঙা নয়, সেটা তো টের পাচ্ছেন। লাঠিও আমরা নিইনি। কিন্তু আপনাদের ইতিমধ্যে কোমর ভেঙে গেছে। শুধু লাঠি নয়, রামদা, তলোয়ার এবং পুলিশের বন্দুকের ওপর আপনারা এখন আছেন। আপনারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন।’
সরকারকে পদত্যাগের পরামর্শ দিয়ে মির্জা ফখরুল বলেছেন, ‘এখনো সময় আছে, পদত্যাগ করুন, সেফ এক্সিট নিন এবং একটা নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।’
বিএনপি চাইলেই যে সরকার পদত্যাগ করবে না; বরং বিএনপিকে মোকাবিলা করার নতুন নতুন উপায় খুঁজবে, সেটাও স্পষ্ট হয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওয়াশিংটনে দেওয়া এক বক্তব্য থেকে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সার্বিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিএনপি সরকারের দুর্নীতি, অনিয়ম ও বিরোধীদের বিরুদ্ধে চালানো নৃশংসতার বর্ণনা তুলে ধরতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এবং দীর্ঘ সময় ধরে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বজায় থাকায় উন্নত দেশের মর্যাদা পেতে যাচ্ছে। আমরা উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে একত্রে কাজ করে যাচ্ছি।’ নির্বাচনের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, ‘তাঁর দল দেশে নির্বাচনের নিরপেক্ষ পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। এর ফলে জনগণ এখন স্বাধীনভাবে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারছে।’
ভোট নিয়ে যেসব অভিযোগ বা বিতর্ক আছে, তা আমলে নিচ্ছেন না সরকারপ্রধান। অথচ শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার কথা বলে আন্দোলন করছে বিএনপি। সরকারের পদত্যাগের এই আন্দোলন সফল হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে সংশয় আছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যেও আন্দোলন নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে সরকার বাধা দেবে না বললেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। কোনো কোনো সভা-সমাবেশ নির্বিঘ্নে হলেও অনেক ক্ষেত্রেই বাধা দেওয়া হচ্ছে। আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবেও বিএনপিকে মোকাবিলা করতে মাঠে নামছে, আবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও বিএনপির মুখোমুখি হচ্ছে। বিএনপিকে বড় কোনো আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি করার সুযোগ সরকার দেবে না বলেই মনে হয়। আন্দোলন যেমন কোনো দল বা নেতার নির্দেশে হয় না, তেমনি মানুষ যদি আন্দোলনে নেমে যায় তাহলে সরকার শক্তি প্রয়োগ করেও তা দমন করতে পারে না। কেবল দলীয় কর্মী-সমর্থকদের হাতে লাঠির মাথায় জাতীয় পতাকা বেঁধে মাঠে নামালেই গণ-অভ্যুত্থান তৈরি হয় না। মানুষ যখন পরিবর্তনটা জরুরি মনে করে এবং পরিবর্তন হলে তাদের জীবনে যে চাপ তৈরি হয়েছে, তার অবসান হবে মনে করবে, তখনই তাদের মধ্যে জাগরণ তৈরি হবে, মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে রাজপথ উত্তাল করে তুলবে। বিএনপি তেমন পরিস্থিতি তৈরির কাছাকাছি যেতে পেরেছে বলে মনে হয় না।