হোম > ছাপা সংস্করণ

শিক্ষা কি আদৌ জাতির মেরুদণ্ড

নুসরাত জাহান শুচি

এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাওয়া কোনো এক শিক্ষার্থীকে ‘আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি’ ইংরেজিতে অনুবাদ করতে বলা হলে সে উত্তর দিয়েছিল, ‘I am GPA-5’ (আই অ্যাম জিপিএ-৫)। বিষয়টি বেশ ভাইরাল হয়েছিল সে সময়। আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয় শিক্ষার মান নিয়ে। এরপর নতুন কোনো বিষয় আমাদের সামনে এল, আমরা ভুলে গেলাম টপিকটা।

তবে টিউশনি করার সুবাদে আজ আবার নতুন করে মনে পড়ে গেল ঘটনাটি।করোনার পর বেশ কিছু শিক্ষার্থীকে পড়িয়েছি। হয়েছে অনেক অভিজ্ঞতা। দেখেছি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া শিক্ষার্থী তিন অঙ্কের যোগ করতে পারে না। অভিভাবক বলেছেন, ‘করোনার জন্য গ্যাপ পড়ে গেছে।’ আমার বোধগম্য হলো না প্রথম, দ্বিতীয় শ্রেণি কি যোগ শেখার জন্য যথেষ্ট ছিল না! যা-ই হোক, ধরে নিলাম ছোট মানুষ শিখে যাবে।

কিন্তু এবার মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য কিছুই পাচ্ছি না। শিক্ষার্থী দশম শ্রেণির। ঢাকার ভেতরের বেশ স্বনামধন্য স্কুলেই পড়াশোনা। সবকিছু ঠিক থাকলে মাধ্যমিক পরীক্ষা হবে ফেব্রুয়ারিতে। দুইয়ের ওপর স্কয়ার (২২) দিলে কত হয়, সে জানে না, মৌলিক সংখ্যা কী তা-ও জানা নেই। সাত দিন চেষ্টা করেও লসাগু শেখাতে পারিনি। শুধু তা-ই নয়, ফিউচার (future)-এর উচ্চারণ ‘ফুটুরি’। মাইট্রোকন্ডিয়া, রাইবোজোম, সালোকসংশ্লেষের মতো উচ্চারণগুলোও ভেঙে ভেঙে শেখাতে হচ্ছে। বোঝাতে হচ্ছে উচ্চারণ কী করে করতে হয়। মনকে বললাম, ‘সমস্যা নেই। সবার মেধা তো সমান হয় না। কোনো বিষয় না। সবাইকে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, এটাতে আমি বিশ্বাসী নয়।’

হয়তো সে পাস করে টেকনিক্যাল কিছু করতে চায়। চার-পাঁচ মাস ভালো করে পড়লেই পাস করে যাবে। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন রেজাল্ট হলে তুমি খুশি?’ উত্তরে সে বলল, ‘জিপিএ-৫ তো লাগবেই।’ এরপর সত্যি আমার বলার কোনো ভাষা ছিল না।

যে শিক্ষার্থীকে ৩-এর নামতা বলতে বললেও দুইবার ভুল করে, সে-ও হয়তো মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েই যাবে। আর যদি না-ও পায়, ফেল তো নিশ্চয় করবে না। ফলাফল কী করবে, তা নিয়ে ভাবছি না। শুধু ভাবনার বিষয়, সে দশম শ্রেণিতে উঠল কীভাবে? 
তাহলে এই কি আমাদের শিক্ষার মান?

শিশু থেকে বৃদ্ধবনিতা সবারই পরিচিত প্রবাদ ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে একটি জাতির মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে শিক্ষা। এ নিয়ে কারও মাঝেই তেমন কোনো মতবিরোধ নেই। কিন্তু যে প্রশ্নগুলোয় আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই, সেগুলোর কয়েকটি নিয়েই না হয় কথা বলা যাক—‘শিক্ষা কী? শিক্ষাব্যবস্থাই-বা কী? আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কি মেরুদণ্ড শক্ত করার শক্তি রাখে? আমাদের দেশে শিক্ষা গ্রহণের উদ্দেশ্যই বা কী?

এবার উত্তরগুলোর খোঁজে বেশ চিন্তার পর আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা আসে সেটিই তুলে ধরার প্রয়াস।  সংস্কৃতি ‘শাস’ ধাতু থেকে শিক্ষা শব্দের উৎপত্তি। সাধারণত জ্ঞান বা দক্ষতা অর্জনকেই শিক্ষা বলে। জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে মানুষের আচরণের কাঙ্ক্ষিত, বাঞ্ছিত ও ইতিবাচক পরিবর্তনই প্রকৃত শিক্ষা।

একটি দেশের চাহিদা, সমস্যা, সংকট ও তার সমাধান, সম্ভাবনা; অর্থাৎ মেরুদণ্ড শক্ত করার হাতিয়ারই হলো শিক্ষাব্যবস্থা। এখন প্রশ্ন হলো, দেশের চাহিদা আবার কী?

সহজ উত্তর: পদ্মা সেতু তৈরিতে আমাদের চীন থেকে প্রকৌশলী আনতে হয়। আর আমাদের দেশের প্রকৌশলীরা পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য কতটুকু? কতগুলোই বা পিলার আছে? সেটি মুখস্থ করে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) পরীক্ষা দিতে যান। আমরা ভুলে যাই আমাদের দেশে শুধু আমলার প্রয়োজন নেই, প্রকৌশলীরও প্রয়োজন আছে। আমাদের চাহিদা আছে বিজ্ঞানীর, চিকিৎসকের, পাইলটের, কৃষকের, দিনমজুরের—প্রত্যেকটি সুনাগরিকের। আর বর্তমানে আমাদের সমাজব্যবস্থা যেদিকে এগিয়ে চলছে, তাতে আমাদের দেশে যেন শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য সরকারি চাকরি করা। চলছে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। বিষয়টা এমন দাঁড়িয়েছে যে ‘আপনি ডাক্তার তাতে কী? বিসিএস ক্যাডার তো আর নন।’

যেখানে একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিজ্ঞানী হতে শেখায় না, চিকিৎসক ও ইঞ্জিনিয়ারকেও বলা হয় ম্যাজিস্ট্রেট হতে, যেখানে উদ্যোক্তার কোনো সম্মান নেই, যেখানে কায়িক পরিশ্রম মানেই কামলা, কৃষিকাজ মানেই অসভ্য চাষা, যেখানে টেকনিক্যাল পড়াশোনা শুধুই গাধারা করে, সেখানে কবি, সাহিত্যিক ও লেখকদের অবস্থা নিয়ে বলাও বাহুল্য।

এখানেই ইতি নয়। উচ্চমাধ্যমিকের মতো পরীক্ষায় সৃজনশীল প্রশ্নের উদ্দীপকে সাম্প্রদায়িকতা, লেখকদের ছোট করা, কর্মজীবী নারীদের নিয়ে কথা তোলা হচ্ছে।

এমন শিক্ষা আর যা-ই হোক জাতির মেরুদণ্ড হতে পারে কি না, তা নিয়ে ভাবার সময় বোধ করি সবার এসে গেছে। অন্যথায় মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো তো দূরের কথা—উঠে বসতে পারবেন কি না, ভেবে দেখুন।

এখনই না ভাবলে এ দেশে আর কখনো জগদীশচন্দ্র বসু (বিজ্ঞানী) জন্মাবে না। বেগম রোকেয়ার জন্ম হবে না আর এ বাংলায়। কাজী নজরুল ইমলাম, জীবনানন্দ দাশ, মাইকেল মধুসূদন দত্তরাও আর জন্মাবে না। জন্মাবে না মিশুক মুনীর, জাহানারা ইমাম। জন্মাবে না রফিক, শফিক আর জব্বারেরা। নতুন করে জন্ম নেবে না পল্লিগ্রামের সেই সাহসী ছেলে।

তাই শিক্ষাকে চাকরি পাওয়ার হাতিয়ার বা কাগজের সেই সনদ না বানিয়ে মেরুদণ্ড হিসেবে গড়ে তুলুন। মনে করে দেখুন সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘দুর্মর’-এর সেই লাইনগুলো

‘সাবাস, বাংলাদেশ, 
এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয় 
জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার
তবু মাথা নোয়াবার নয়।’

লেখক: সাংবাদিক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ