হোম > ছাপা সংস্করণ

সাধারণই এ যুগের ‘বুধো’

ফজলুল কবির

কথায় আছে—উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে। গল্পটি যা-ই হোক, অর্থটি পরিষ্কার। সহজ লক্ষ্যবস্তুর ওপর দায় চাপানোর মানসিকতা বোঝাতেই এর ব্যবহার। বাংলাদেশে এই সহজ লক্ষ্যবস্তু কে, তা সবিস্তারে না বললেও চলে। এর নাম সাধারণ। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং সেই সূত্রে গণপরিবহন, পণ্য পরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধি—এই সবকিছুই কিন্তু এই ‘বুধো’ নামক সাধারণের ঘাড়েই চাপছে।

সাধারণকে অনেকে বলেন আবার ‘আমজনতা’। যদিও এ-ও এক নতুন ধারা হয়ে আছে। এই ‘আম’ শব্দটিও আর সাধারণের দখলে নেই। এ নিয়েও আছে বিস্তর রাজনীতি। যেকোনো পক্ষই নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান ও লক্ষ্যের সঙ্গে এই আমজনতাকে জড়িয়ে নেন সহজেই। আর সাধারণও যেন জড়িয়ে যাওয়ার জন্যই প্রস্তুত থাকেন। ফলে কাজটি অনেকটা সহজ হয়।

জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বেশ কয়েক দিন সড়কে কোনো গণপরিবহন চলেনি। বন্ধ ছিল পণ্যবাহী যানবাহনও। নৌ বা সড়ক—সবখানেই সরকারি বাহন ছাড়া আর কিছু চলেনি। আবার এসব সরকারি বাহনেও যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করা হয়েছে। এ নিয়ে জনমনে ক্ষোভও আছে। কিন্তু বহিঃপ্রকাশ নেই। মানুষ হিসাবটি না জানলেও বুঝে গেছে ভেতর থেকে যে, আওয়াজ দিয়ে লাভ নেই।

সরকারি বাহনে বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে কেউ আনুষ্ঠানিক কোনো অভিযোগও করেনি। কেন করবে? কোনো কারণ নেই। মানুষ জানে, সরকার নিজেই এই ব্যবসার আসল পরিচালক। জ্বালানি তেলের ব্যবসা থেকে গত ছয় বছরে সরকারের আয় হয়েছে ৬৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) তেল বিক্রি করে লাভ করেছে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আর এই তেল আমদানির ওপর ভ্যাট-ট্যাক্সসহ বিভিন্ন শুল্ক ও আবগারি কর বাবদ সরকার রাজস্ব পেয়েছে প্রায় সাড়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা; অর্থাৎ সরকার গাছেরটাও খেয়েছে, তলারটাও কুড়িয়েছে। এ দুই দিয়ে বেশ ভালো ব্যবসা হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বিরাট অঙ্কের এই মুনাফায় টান পড়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে।

কতটা বেড়েছে? খোদ মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্যের কারণে তিন মাস ধরে সরকারের লোকসান হচ্ছে এবং তা দিনে ২০-২২ কোটি টাকার মতো। প্রতিদিন ২১ কোটি টাকা হিসাব করলেও তিন মাসে মোট লোকসান দাঁড়ায় ২ হাজার কোটি টাকার কম। আগামী তিন মাস এই লোকসান চললেও জ্বালানি তেল খাতে সরকারের বাড়তি খরচ হওয়ার কথা ২ হাজার কোটি টাকা। ফলে এত দিনের যে আয়, তা ফুরিয়ে যাওয়ার তেমন শঙ্কা ছিল না। মুনাফা কমে এসেছিল। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, লোকসানে চলছিল পুরোটা। অপেক্ষা করা যেত। এমনকি শুল্ক ও কর থেকে হওয়া আয়ের সঙ্গে এর সমন্বয় করে নেওয়া যেত। কিন্তু তেমন কিছু না করেই সরকার এক টানে ১৫ টাকা লিটারে দাম বাড়িয়ে দিল।

এই মূল্যবৃদ্ধি এমন এক সময় হলো, যখন করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে অর্থনীতি। আর এ ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতই ভরসা। অর্থনীতিবিদেরা অনেক আগে থেকেই বলছেন, করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সবচেয়ে ভালো পন্থা হলো ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের দিকে নজর দেওয়া। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা থেকে শুরু করে নানা ধরনের কেন্দ্রীয় উদ্যোগ থাকে। কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পমালিকেরা থাকেন সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এ কথা আরও সত্য। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের একটা বড় অংশ আবার অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের। করোনায় এ খাতই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অথচ সরকার এই খাতের দিকে না তাকিয়ে বলা যায় একতরফাভাবে হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়াল।

এই মূল্যবৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব হিসেবে এরই মধ্যে যাত্রী পরিবহনে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এই ভাড়াও আবার অযৌক্তিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম ২৩ শতাংশ বৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় ভাড়া বেড়েছে ২৭ শতাংশের মতো। আবার এই ভাড়া বেড়েছে যাত্রীপ্রতি। অথচ সহজ অঙ্কই বলছে, যাত্রীপ্রতি ভাড়া বাড়লেও তা অনেক কম হওয়ার কথা। কিন্তু তেমনটি হয়নি। সরকার ও পরিবহন মালিকেরা এ ক্ষেত্রে সাধারণের ঘাড়ে যাবতীয় ভার তুলে দেওয়ার সুযোগটিই নিয়েছেন। বেড়েছে পণ্য পরিবহন ব্যয়ও। এর সরাসরি প্রভাব পড়তে যাচ্ছে এরই মধ্যে আগুন হয়ে থাকা দ্রব্যমূল্যের বাজারে। কিন্তু এই অঙ্ক যারা বোঝার কথা তারাও নীরব। দেশের বামপন্থী দলগুলো জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৮ নভেম্বর আধা বেলা হরতাল ডেকেছে। এটি কোন লগ্ন বেছে করা হলো, তা ঠিক স্পষ্ট নয়।

বেশ কিছু দিন ধরেই সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বাড়তি বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। এই বাজার পরিস্থিতিকে সাধারণের জন্য সহনীয় করতে তেমন উদ্যোগ দেখা না গেলেও সরকার ঠিকই সেই আগুনে ঘি ঢালার কাজটি করে দিল। এ ক্ষেত্রে এমনকি একবারও সাধারণের আর্থিক সংগতির বিষয়টি ভেবে দেখা হয়নি। পুরো একতরফা একটি পদক্ষেপ।

করোনায় দেশে অর্থনৈতিক যে সংকট হয়েছে বা যে সংকটের মধ্য দিয়ে মানুষ যাচ্ছে, তা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মাথাপিছু আয়ের বর্ধিত হিসাব বা রেমিট্যান্সপ্রবাহ ইত্যাদি দিয়ে বোঝা যাবে না। এটি বুঝতে হলে সাধারণের কাছে যেতে হবে, যাঁরা করোনায় চাকরি হারিয়েছেন, ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হয়েছেন, শহর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন এবং শহর ছাড়ার কারণে যাঁদের বাড়িতে বাড়িতে টু-লেট ঝোলাতে বাধ্য হয়েছেন। এই গোটা সময়ে চাকরি ও ব্যবসা হারানো মানুষদের অনেককেই মোটা অঙ্কের ঋণ নিতে বাধ্য হতে হয়েছে। বহু শিক্ষার্থীকে ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিয়ে ঝরে পড়তে হয়েছে। এই মানুষদের কারও কথা একবারও ভাবা হয়নি। ভাবলে ঋণে জর্জর এই মানুষদের আয়-উপার্জনের পথটিকে সরল করতে সরকার আরও অন্তত কিছুদিন জ্বালানি তেলের ব্যবসা থেকে মুনাফা না গুনে থাকতে পারত।

অথচ সরকার ঠিকই বিপরীত অবস্থান নিল। তারা সাধারণের বিরুদ্ধে সাধারণকেই দাঁড় করিয়ে দিল। আর সেই কথামালার ‘বুধোর’ মতো করেই সাধারণও সেই সুযোগটি অবারিত করে একের বিরুদ্ধে আরেক দাঁড়িয়ে গেল। সরকার ও পরিবহন মালিকের জোটে ফাটল না ধরলেও সাধারণ যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের বিচ্ছিন্নতা কাটল না এবারও। তাঁরা পরস্পরের মুখোমুখি আবারও দাঁড়িয়ে গেল নিজেদের অজ্ঞাতেই। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়ায় যখন পরিবহন মালিকেরা গাড়ি বন্ধ রাখল, তখন তাতে বাধ্য হয়ে সমর্থন দিতে হলো শ্রমিকদের। আর যখন ধর্মঘট তুলে নেওয়া হলো, তখন স্বাভাবিকভাবেই মালিকদের দেখানো পথ ধরেই ভাড়া আদায়ে নামতে হলো। ফল—সরকার ও মালিক এখন এক টেবিলে বসে চা খাচ্ছে। আর শ্রমিক ও সাধারণ যাত্রী নেমেছে এক নিরন্তর লড়াইয়ে। নির্ধারিত বর্ধিত ভাড়া এবং তার চেয়েও বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে তারা ঝগড়া করে করে ক্লান্ত হওয়ার আগেই হয়তো বুধোর ঘাড়ে নতুন কিছু চেপে বসবে।

ফজলুল কবির,সহকারী বার্তা সম্পাদক, আজকের পত্রিকা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ