আল্লাহ তাআলার বিধানানুসারে যে চারটি মাস পবিত্র ও সম্মানিত, তার অন্যতম জিলহজ। হিজরি সনের সর্বশেষ মাস জিলহজ অনেক ফজিলতপূর্ণ। এ মাসের সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ও মর্যাদাপূর্ণ সময় হলো ‘আশারায়ে জিলহজ’ বা জিলহজ মাসের প্রথম দশক। কোরআন-হাদিসে এই দশকের বিশেষ ফজিলত ও অসীম গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। এই দশকের সম্মান ও পবিত্রতা প্রকাশ করতে আল্লাহ তাআলা এর রাতগুলোর নামে শপথ করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘শপথ ভোরের, শপথ দশ রাতের।’ (সুরা ফজর, আয়াত: ১-২)
অধিকাংশ সাহাবি, তাবেয়ি ও মুফাসসিরের মতে, এখানে ১০ রাত দ্বারা জিলহজ মাসের প্রথম ১০ রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (ইবনে কাসির: ৪ / ৫৩৫-৫৩৬)
হিজরতের দশম বছরে, জিলহজের ৯ তারিখ আরাফাত দিবসে মহান আল্লাহ ইসলামের পূর্ণতা ঘোষণা করেন। এরশাদ হয়েছে, ‘আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত: ৩)
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, ‘জিলহজের ১০ দিনের ইবাদত আল্লাহর কাছে অন্য দিনের ইবাদতের তুলনায় অধিক প্রিয়। প্রত্যেক দিনের রোজা এক বছরের রোজার মতো এবং প্রত্যেক রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের মতো।’ (তিরমিজি, হাদিস: ৭৫৮)
মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘জিলহজ মাসের প্রথম ১০ দিনের আমল আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয় আমল—এমনকি আল্লাহর পথে জিহাদ করার চেয়েও বেশি প্রিয় আমল।’ (বাযযার, হাদিস: ১১২৮)
হজযাত্রী ছাড়া বাকি সব মুসলমানের জন্য জিলহজ মাসের ৯ তারিখ রোজা রাখা সুন্নত। মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘আরাফাতের দিনের রোজার ব্যাপারে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে এ রোজা তার আগের ও পরের বছরের গুনাহ মুছে ফেলবে।’ (মুসলিম, হাদিস: ৭৪০)
তবে যাঁরা হজ পালন করছেন, তাঁদের জন্য এই দিনে রোজা না রাখা উচিত। কারণ, মহানবী (সা.) আরাফাতের দিনে আরাফাতের ময়দানে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন। (আবু দাউদ, হাদিস: ২৪৪২)
জিলহজের প্রথম দশক সম্পর্কিত বিভিন্ন হাদিস থেকে পাওয়া আমলগুলো নিম্নরূপ—
১. তওবা করা, ২. ফরজ ও নফল নামাজগুলো গুরুত্ব দিয়ে আদায় করা, ৩. নখ-চুল না কাটা, ৪. প্রথম ৯ দিন রোজা রাখা, ৫. আরাফাতের দিন তথা ৯ জিলহজ রোজা রাখা, ৬. হজ ও ওমরাহ করা, ৭. রাতগুলোতে বেশি বেশি জিকির-তাসবিহ করা, ৮. তাকবির, তাহলিল ও তাহমিদ পড়া, ৯. ঈদ ও আইয়ামে তাশরিকে রোজা না রাখা, ৮. ঈদুল আজহার নামাজ পড়া এবং ৯. কোরবানি করা।
কোরবানির বিধান ও ফজিলত
কোনো প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন পুরুষ ও নারীর মালিকানায় নিসাব পরিমাণ তথা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ, অথবা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা বা এর সমমূল্যের সম্পদ থাকলে তাঁর ওপর ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত যেকোনো একদিন কোরবানি করা ওয়াজিব। (ফাতাওয়া শামি: ৯/৪৫৩ ও ৪৫৭)
মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকেও কোরবানি করা জায়েজ। মৃত ব্যক্তি যদি অছিয়ত না করে থাকে তবে সেটি নফল কোরবানি হিসেবে গণ্য হবে। কোরবানির স্বাভাবিক গোশতের মতো তা নিজেরাও খেতে পারবে এবং আত্মীয়স্বজনকেও দিতে পারবে। আর যদি মৃত ব্যক্তি কোরবানির অছিয়ত করে থাকে, তবে এর গোশত নিজেরা খেতে পারবে না। গরিব-মিসকিনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। (আহমদ, হাদিস: ৮৪৫)
মহানবী (সা.) এরশাদ করেন, ‘আমি কোরবানির দিন সম্পর্কে আদিষ্ট হয়েছি। আল্লাহ তাআলা তা এ উম্মতের জন্য ঈদ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।’ এক ব্যক্তি আরজ করল, ‘হে আল্লাহর রাসুল, যদি আমার কাছে শুধু একটি মানিহা তথা শুধু দুধপানের জন্য রাখা পশু থাকে?’ আল্লাহর রাসুল (সা.) বললেন, ‘না, বরং সেদিন তুমি তোমার চুল কাটবে, নখ কাটবে, গোঁফ ও নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করবে। এটিই আল্লাহর কাছে তোমার পূর্ণ কোরবানি বলে গণ্য হবে।’ (আহমদ, হাদিস: ৬৫৭৫)
সাহাবিগণ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জানতে চাইলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, এ কোরবানি কী?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘তোমাদের পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর সুন্নত।’ তাঁরা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, তাতে আমাদের জন্য কী সওয়াব রয়েছে?’ উত্তরে তিনি বললেন, ‘কোরবানির পশুর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে একটি সওয়াব রয়েছে।’ তাঁরা আবারও প্রশ্ন করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, ভেড়ার লোমের কী হুকুম?’ (অর্থাৎ, এটা তো গণনা করা সম্ভব নয়)। তিনি বললেন, ‘ভেড়ার প্রতিটি পশমের বিনিময়েও একটি সওয়াব রয়েছে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৬)
মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোরবানি করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের কাছেও না আসে।’ (ইবনে মাজাহ, হাদিস: ২২৬)
কোরবানির পশু ও অন্যান্য
যেসব পশু শরিয়ত নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা দিয়েই কেবল কোরবানি দেওয়া যাবে। আর তা হলো—উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা। এ পশুগুলোকে কোরআনের ভাষায় বলা হয় ‘বাহিমাতুল আনআম’। ভেড়া, দুম্বা, ছাগল দিয়ে এক ব্যক্তি একটা কোরবানি করতে পারবেন। আর উট, গরু, মহিষ দিয়ে সাতজনের পক্ষ থেকে সাতটি কোরবানি করা যাবে। অন্ধ, কানা, খোঁড়া পশু দিয়ে কোরবানি করা জায়েজ নেই। (রদ্দুল মুহতার: ৬/৫৩৫)
পশু কোরবানির ক্ষেত্রে পশুর যাতে অতিরিক্ত কষ্ট না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।
কোরবানির চামড়া এটি জাতীয় সম্পদ। তাই কোরবানিদাতার খেয়াল রাখতে হবে—চামড়া যেন কোনোভাবেই নষ্ট না হয়। এটিও জানা প্রয়োজন যে কোরবানির চামড়ার বিক্রীত অর্থ গরিবদের মাঝে বিতরণ করতে হবে।
ইসলাম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতি বেশ জোর দেয়। তাই কোরবানির সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে সবার সহযোগিতা একান্ত কাম্য। আল্লাহ তাআলা আমাদের কোরবানি কবুল করুন। আমিন।