হোম > ছাপা সংস্করণ

আগত বর্ষে কেমন স্বদেশ চাই আমরা?

অজয় দাশগুপ্ত

যা শুনি, যা বলা হয়, যা প্রচার—সেটা পজিটিভ বা নেগেটিভ যা-ই হোক না কেন, মূলত বাস্তবতা তেমনটি নয়। বিদেশে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা পজিটিভ ইমেজের বাংলাদেশের সামনে অনেক পথ বাকি। সন্তোষ বা সেটিসফেকশন নিজেদের ব্যাপার। বাস্তবে যেতে হবে অনেক দূর। তাই প্রশ্ন জাগে, সত্যিকার অর্থে কেমন আছে বাংলাদেশ? কেমন আছে মানুষজন? আমরা যাঁরা দেশের বাইরে বসবাস করি, সেখানকার সমস্যাগুলো আমাদের জীবনপ্রবাহে আঘাত হানতে পারে না। তাই আমাদের দেখা স্বদেশ মায়া আর কল্পনার স্বদেশ। কিন্তু আকাশকে চ্যালেঞ্জ জানানো ইট-সুরকি-বালির ধোঁয়াওঠা উন্নয়নের আড়ালে কেমন আছেন আমাদের স্বজনেরা?

পরিসংখ্যান বিষয়টা সব আমলে একতরফা। বিশেষত গোলমেলে। তাই এগুলোর ওপর নির্ভর করা ঠিক মনে করি না। কিন্তু এটা মানি, দেশ এগিয়েছে। কিন্তু সমাজ? আমাদের দেশে চলমান অসাম্প্রদায়িক ধারা এ বছর সবচেয়ে বেশি আহত হয়েছে। শারদীয় দুর্গাপূজার সময় ঘটে যাওয়া ঘটনার দায় সরকার বা প্রশাসন এড়াতে পারে না। এর সঙ্গে একদিকে যেমন নারীর উন্নয়ন অগ্রযাত্রা, অন্যদিকে ক্রমাগত উধাও খোলা মাথা খোঁপার নারীশক্তি। সবকিছুর ওপরে আছে করোনার ভয়াল থাবা।

ষাট পেরিয়ে যাওয়া আমরা বহু পতন দেখেছি। দেখেছি কঠিন সময়। মুক্তিযুদ্ধের মতো কঠিন সময় দেখেছি আমরা। সেসব ইতিহাস হত্যা-নিপীড়ন চোখে দেখার পরও বলব এমন সময় আসেনি আগে। শুধু কি বাংলাদেশ? পুরো দুনিয়া আজ আতঙ্কে-ভয়ে মুহ্যমান। আমি বিগত প্রায় আড়াই দশক পৃথিবীর উন্নত ও জীবনযাপনের মানে সেরা এক দেশের সেরা শহর সিডনিতে বাস করি। আজ সেখানেও আমরা ভালো নেই। কেউ ভালো নেই কোনো দেশে।

বছরের শেষ দিকে আমরা কী খবর পেলাম? বিশ্বে জ্ঞানবিজ্ঞান জানা দেশের সূচকে আমরা ১৩৮টি দেশের তালিকায় আছি ১২১ নম্বরে। যে পাকিস্তানকে আমরা আয়, টাকার মান, শিশুমৃত্যু, নারীর উন্নয়নে হারিয়েছি বলে গর্ব করি; সে পাকিস্তানও আছে আমাদের আগের সারিতে। এ কথা মানতে হবে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী ও জড়িতরা বাদে লেখাপড়া নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। একটি দেশের ভিত্তি যে মেধা, সেটাই আজ নিদারুণ দুর্বিপাকে। কী ভয়াবহ কথা! আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ দুঃসংবাদ নিয়ে আমরা প্রবেশ করছি আরেকটি নতুন বছরে। আপনি, আমি, আমরা যে দেশে, যে সমাজে বাস করি না কেন, একটা বিষয় দেখি, দেশে লেখাপড়া আছে সবার নিচে। এই যে স্কুল-কলেজ বন্ধ, অনলাইনে কোনোরকমে কাজ সারা—এর প্রতিকার নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়? সবাই ব্যস্ত ভাস্কর্য-মূর্তি বয়ান আর ধর্ম নিয়ে।

করোনার এই ভয়াবহতার পরও দেশে হত্যা, জখম, খুন, ধর্ষণ কমেনি। বেড়েছে অনাচার। সেসব কিছু বাদ দিয়ে একদল মানুষ নেমেছে দেশ ও জাতিকে পেছনে টানার কাজে। তাদের মাথায় এক চিন্তা এক ভাবনা। কীভাবে আমাদের সব অর্জন নষ্ট করে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গুঁড়িয়ে দেশ ও জাতিকে উগ্র করে তোলা যায়, সে ধান্দায় এরা গত বছর নেমেছে ভাস্কর্য ভাঙার কাজে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানদের ওপর হামলা করতে করতে হাত পাকানো এরা এবার হাত দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে। জাতির পিতার কন্যার শাসনামলে তারা আওয়ামী লীগের তোয়াক্কা না করেই ভেঙেছে তাঁর ভাস্কর্য। কী ভয়ংকর কথা! আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের সঙ্গে আপসে সমাধান করার জন্য বৈঠকও করেছেন। একবার ভাবুন, সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল মাঠে নামতে পারে না, আর এরা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভেঙেও মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারে। আরও একটি বিষয় বলি। যে ভাষায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বলা উচিত, সে ভাষায় কথা বললেন পুলিশপ্রধান, পুলিশ সুপাররা। তাঁদের স্যালুট জানাই। এতে প্রমাণিত হয়, আমাদের রাজনীতি কত দুর্বল আর ভঙ্গুর এখন।

এই বছরে দেশের পাশাপাশি বিদেশের অর্থনীতির অবস্থাও খারাপ। কেউ কাউকে সাহায্য করার জায়গায় নেই। তারপরও বাংলাদেশের যেসব মেধাবী মানুষ, পরিশ্রমী মানুষ অর্থনীতিকে সচল রাখেন, তাঁদের খবর নেই কোথাও। জাতির সেরা সন্তান কৃষক, শ্রমিক, পোশাকশিল্পীদের কোনো খবর থাকে না মিডিয়ায়। তাঁরা সামনে থাকলে মানুষ এসব আজেবাজে নেতার মুখ দেখা থেকে মুক্তি পেতেন। সে কাজটি মিডিয়া করে না। করতে চায় না।

গত বছর দুনিয়াজুড়ে করোনার যে তাণ্ডব, তার কোনো ব্যাখ্যা কিংবা সমাধান মেলেনি। সবাই জানি, শুরুতে চীনের একটি প্রদেশকে দায়ী করে উৎসভূমি বলাটা চালু হলেও পরে সে বিষয়ে আর কোনো ব্যাখ্যা মিলল না। যে কারণে যেভাবেই হোক, এই মহামারির আক্রমণে ছোট-বড় সব দেশের জীবন কাহিল। এমনকি সম্প্রতি অ্যান্টার্কটিকার মতো বরফঢাকা নির্জন মহাদেশেও পাওয়া গেছে করোনা রোগী! অনেকে মনে করেন, দুনিয়ায় বসবাসরত দীর্ঘায়ু বয়স্কজনদের চাপ আর নিতে রাজি নয় ধনী দেশের সরকার। তাই আমেরিকা-ইউরোপে তাদের বিদায়ে বা মৃত্যুতে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল নির্বিকার থাকা। এমনকি একসময় বয়স্ক মানুষের মুখ থেকে শ্বাসযন্ত্র খুলে তাঁদের চলে যাওয়ার ব্যবস্থা দ্রুত নিশ্চিত করেছিল অনেক দেশের সরকার।

এ ধরনের অমানবিক-নিষ্ঠুর আচরণ আমরা আর দেখতে চাই না। যদি বাংলাদেশের কথা বলি, সেখানে এমন কাণ্ড হয়নি, তবে আসলে করোনা রোগীর সংখ্যা কত আর কারা রোগী, কারা নয়—এই সবই মূলত রহস্যময়। এখন অবধি উন্নয়নের নামে ভাসমান জাতি এই জরুরি কাজ শেষ করতে পারেনি। বরং আমরা সাহেদের মতো করোনা-ব্যবসায়ীদের চেহারা দেখে জেনেছি, মহামারি ও তার সার্টিফিকেটও ব্যবসার উপাদান হতে পারে।

সবশেষে বলব, আমাদের সমাজ ও বাংলাদেশিদের জীবনে এখন প্রধান বৈরী মূলত মৌলবাদের থাবা। জাতি, জাতীয়তা ও আমাদের ভবিষ্যতের ওপর এই থাবা নতুন করে তার আধিপত্য বিস্তার করছে। এমন-না যে, এগুলো আগে ছিল না। কিন্তু এখন তারা মূলত অপ্রতিরোধ্য। সমাজে তাদের সংখ্যা এখন বেশি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সরকারের কঠোরতা না থাকলে কবেই গিলে খেত তারা। এখনো খাবে। কারণ, সমাজে ৭০-৮০ শতাংশ মানুষের মগজধোলাই করার কাজ শেষ। তারা মনে মনে এসব মৌলবাদের হয় প্রচ্ছন্ন নয়তো কড়া সমর্থক। আগামী বছরে তো বটেই, সামনের বছরগুলোয় বাংলাদেশের বড় চ্যালেঞ্জ—এর মোকাবিলা। ব্যর্থ হলে দেশে পতাকা সংগীতসহ বহু মৌলিক বিষয়ে যে পরিবর্তন ঘটবে, তা কেউ ঠেকাতে পারবে না।

বিশ্বায়নের অপব্যাখ্যা আর ভুল প্রয়োগ এ জন্য কম দায়ী নয়। সঙ্গে আছে প্রতিবেশী দেশের জন্য যৌক্তিক ও অযৌক্তিক প্রেম এবং বিরোধিতা। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও প্রগতিশীল বাঙালি মুসলমানের জন্য এমন কঠিন সময় আগে আসেনি। কারণ, আগে রাষ্ট্র ও সরকারে থাকা মানুষজন গোঁড়া হলেও ছিলেন উদার আর প্রগতিশীল। এখন উল্টো ধারা চলছে দেশে। কে যে কোথায় কোন অবস্থানে, কেউ জানে না।

তবু আশা করি, আগামী বছর নতুন এক স্বদেশ—নবীন, তারুণ্য আর নব আন্তর্জাতিকতা মিলে রচিত হবে নতুন ভুবন। জয় হোক মানুষের। জয় হোক মানবিক বিশ্ব ও বাংলাদেশের।

অজয় দাশগুপ্ত: অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ