হোম > ছাপা সংস্করণ

বর্গিরা থাকে ঘাপটি মেরে, রক্ত চোষে সময় পেলে

আব্দুর রাজ্জাক

সেই ব্রিটিশ আমলের বর্গিদের কথা আমরা জানি। তাদের শোষণ, তাদের শাসন, তাদের অত্যাচার, জুলুমের কথা এখনো সবার মুখে মুখে। বিদেশি বর্গিদের হাত থেকে আমরা হয়তো সাময়িক মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু দেশীয় নব্য বর্গিরা তাদের চেয়েও ভয়ংকর। বলা হয়, দেশীয় সম্পদের বেশির ভাগ এই নব্য বর্গিদের হাতে। এই বর্গিদের কয়েকটি সেক্টর সম্পর্কে সবিনয়ে দু-একটি কথা বলতে চাই।

বর্তমান সময়ের আলোচিত খাত—তেল। ভোজ্যতেলের নৈরাজ্য গত দুই-তিন মাসের আলোচিত ঘটনা। তেল নিয়ে যে এই তেলেসমাতি, এর কারণ হলো দেশীয় যে পাঁচটি কোম্পানি অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করে পরিশোধিত করে, আমাদের সরবরাহ করে, তাদের হাতে তেল মার্কেট জিম্মি। এসব কোম্পানি বেশ কিছু বছর যাবৎ তাদের প্রোপাগান্ডা দিয়ে এই সয়াবিন ও পাম অয়েলের ওপর আমাদের জাতিকে পরিপূর্ণভাবে নির্ভরশীল করে তুলেছে। যার কারণে আমরা এখন আমাদের পূর্বপুরুষের তেল খাওয়ার অভ্যাস পরিবর্তন করে তাদের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের রক্ত এখন এরা শুষে নিচ্ছে পরিশোধিত তেল দিয়ে। এই কোম্পানিগুলো সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করার দরুন আমরা সরাসরি পরিশোধিত তেল আমদানি করতে পারি না।

আমরাই ছোটবেলায় দেখেছি, দেশীয় সরিষার তেল দিয়ে আমাদের চাহিদা পূরণ হতো। বোতলে করে গৃহস্থ পরিবাররা এক পোয়া, আধা সের সরিষার তেল দিয়ে সপ্তাহ পার করত। বহুজাতিক কোম্পানির বিভিন্ন প্রোপাগান্ডার কারণে আমাদের সেই সুস্বাদু সরিষার তেলের খাবার থেকে বঞ্চিত হলাম।

ভারত গম রপ্তানি বন্ধ করেছে বলে ২০০ টাকা করে মণপ্রতি এর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। গমের দাম বাড়ার ওপরে নির্ভর করে আটার দাম, যা আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় অত্যাবশ্যকীয়। এখন দেখা যাক এ নিয়ে কী তুঘলকি কাণ্ড ঘটে।

এখন আসা যাক পোশাকশিল্প খাত সম্পর্কে। পোশাকশিল্প খাতের উদ্যোক্তা, হর্তাকর্তা, বিধাতা বা বর্তমান কর্ণধার—সবাইকে আমরা কমবেশি চিনি। আশির দশকের গোড়ার দিকে তাঁরা প্রায় সবাই ঢাকা শহরে ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ঘুরে বেড়াতেন। তাঁদের বেশির ভাগই খুব একটা মেধাবী ছিলেন না। মধ্যম অথবা নিম্নমানের লেখাপড়া ও বিদ্যাবুদ্ধি নিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করলেন। কিন্তু তাঁরা কর্মোদ্যম ছিলেন। প্রথমে কারও অধীনে দু-এক বছর কাজ করে নিজেরাই আরম্ভ করলেন এই ব্যবসা। নিজেরা কারও ওপর বোঝা না হয়ে নিজেদেরই কর্মসংস্থান করলেন এবং অন্যকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিলেন। এই পর্যন্ত তাঁদের সাধুবাদ জানাতেই হয়।

ওই কর্ম উদ্যোগী মানুষগুলো কেন যেন অব্যবস্থাপনা ও অসৎ উদ্দেশ্যে এবং শোষকের মানসিকতা নিয়ে তাঁদের নিজেদের সমাজের, তাঁদের চারপাশের কিছু মানুষকে শোষণ করতে আরম্ভ করলেন। রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের টাকা, শুল্ক ফাঁকির টাকা আত্মসাৎ করে নিজেরা রাষ্ট্রীয় শক্তির সমান্তরাল শক্তিতে পরিণত হলেন। এসবের মূলে ছিল হঠাৎ করে হাতে লুণ্ঠিত অর্থ আসা।

যেহেতু আমাদের সমাজব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান, শুল্ক খাত, আয়কর খাত, পরিবহনব্যবস্থাকে কলুষিত করে তাঁরা গড়ে তুললেন একের পর এক কারখানা। আমাদের সমাজের সস্তা শ্রম ও শ্রমের কোনো মূল্য নির্ধারণ না থাকার কারণে একে পুঁজি করে তাঁরা হঠাৎ করে কোটিপতি বনে গেলেন। আত্মসাৎ করলেন ব্যাংকের তারল্য পুঁজি। দখল করলেন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ও ভালো ভালো জায়গা-জমি।

এসব ভাগ্যান্বেষী মানুষ রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনার দরুন কোটিপতি থেকে শতকোটি টাকা, হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেলেন। তাঁরা সংগঠন করলেন, সংগঠনকে মজবুত করলেন। তাঁরা দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, বাণিজ্যনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেললেন। তাঁরা আছেন সংসদে, মন্ত্রিসভায়, রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বড় বড় পদে।

টাকাপয়সা নেই—এই বলে তাঁদের শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন দিতেও তাঁরা অস্বীকার করেছেন। তাঁদের নিট সম্পদের হিসাব করে দেখুন, ২০ বছর আগে যাঁর ছিল এক কোটি টাকা, তাঁর এখন শতকোটি টাকা।

স্বাস্থ্য খাতের বর্গিদের কথায় আসি। আমাদের দেশের কিছু শিক্ষিত তরুণ, তাঁরা মেধাবীও বটে, চিকিৎসাশাস্ত্রে বিদ্যা অর্জন করে মানুষকে চিকিৎসা দেবেন, এই ব্রত নিয়ে কাজ আরম্ভ করলেন। কেউ সরকারি চাকরি, আবার কেউ সরকারি চাকরি না পেয়ে ছোটখাটো ক্লিনিক বা ফার্মেসি খুলে মানুষকে সেবা দিতে আরম্ভ করলেন। মানুষের জীবনযাত্রার মান একটু উন্নত হওয়ার দরুন এসব ডাক্তার-শ্রেণির ব্যবসায়ীরা প্রথমে ছোটখাটো ক্লিনিক, তারপর ডায়াগনস্টিক সেন্টার, তারপর ছোটখাটো হাসপাতাল বানিয়ে আমাদের রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাব্যবস্থাকে ব্যক্তি খাতের দিকে নিয়ে এলেন। রাষ্ট্রীয় খাতের চিকিৎসকেরা পার্টটাইম কাজের অজুহাত দেখিয়ে রাষ্ট্রীয় চিকিৎসাব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ব্যক্তি খাতের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে ফুলে ফেঁপে উঠতে সাহায্য করলেন। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা এই ব্যক্তি খাতের কাছে এখন জিম্মি। এসব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামে ওই সব অসাধু ডাক্তার ও ব্যবসায়ী যতটা শোষণ করার তা করে নিয়েছেন। করোনা পরিস্থিতি শেষ হলে আবার হয়তো জেঁকে বসবেন।

পরিবহন খাতের দিকে আসি এবার। এখানে অনেকগুলো সংগঠন আছে—মালিক সংগঠন, শ্রমিক-মালিক সংগঠন, শ্রমিক কল্যাণ সংগঠন, খাঁটি শ্রমিক সংগঠন ইত্যাদি। এসব সংগঠনের লোকজন সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ফেলতে পারে এক ঘণ্টার মধ্যে। এসব সংগঠনের নেতারা আবার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করেন। নেতারা কেউ ডান, কেউ অতি ডান, কেউ বাম, কেউ অতি বাম। কেউ আবার জানেনই না তিনি কে। তাঁরা শুধু প্রতিদিনের পাওনা চান। বিভিন্ন সংগঠনের নামে তাঁরা বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা চাঁদা তুলছেন। এখন এই দুঃসময়ে পরিবহনশ্রমিকদের সবচেয়ে বেশি খারাপ বললে অত্যুক্তি হবে না।

শিল্প উদ্যোগের নামে একশ্রেণির লুটেরা শিল্পপতি ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কিছু টাকা দিয়ে শিল্প করেন। বাকি টাকা পাচার করে ঋণখেলাপি হয়ে বসে আছেন। নিজের সম্পত্তি বিদেশেও পাচার করছেন।

কেউবা আবার ১০ টাকার সম্পত্তি ৫০ টাকা দেখিয়ে পুঁজিবাজার থেকে হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়ে বর্গি হয়ে বসে আছেন।

শিক্ষা খাতেও বর্গি তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ, টেকনিক্যাল কলেজ, কোচিং সেন্টারের নামে শিক্ষাকে কুক্ষিগত করেছেন অনেকে।

সাধারণ চোখে মনে হবে কৃষি খাতে কোনো বর্গি নেই। যদি প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের আর্থিক ও সামাজিক অবস্থা দেখেন, তাহলেই বুঝতে পারবেন কেমন করে তাঁরা শোষিত হচ্ছেন। কৃষিপণ্য যারা পরিবহন করে, কৃষিতে ব্যবহৃত সার ও কীটনাশক উৎপাদন করে, বাজারজাত করে, তাদের আর্থিক অবস্থা এবং ফসল ফলান যাঁরা, তাঁদের আর্থিক অবস্থার পার্থক্য দেখলে এই খাতের বর্গিদের চিনতে কোনো অসুবিধা হবে না।

ব্যাংকিং খাতে আছে দাদনব্যবস্থা। কিছু কিছু নব্য ধনী প্রাইভেট ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নামে সরকারি খাত থেকেই ঋণ নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা গড়ে তুলছেন। সেখান থেকে তাঁরা তুলে নিচ্ছেন হাজার কোটি টাকা। মুনাফা শোষিত হচ্ছেন প্রান্তিক পর্যায়ের ছোটখাটো ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।

এনজিও নামক বর্গিরা কম যায় না! অনেক এনজিওর প্রধান কর্তাব্যক্তিরা আমাদের সমাজের বিভিন্ন দুর্বলতার দিক তুলে ধরে বিদেশি প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ এনে নিজেরাই আজ বর্গিদের ভূমিকায়। এসব এনজিওর অত্যাচারে কত যে সাধারণ নিরীহ মানুষ নিঃশেষ হয়ে গেছে বা আত্মহত্যা করেছে, তার একটা হিসাব হওয়া উচিত।

সরকারি কিছু আমলা, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজেরাই নিজেদের বর্গি মনে করেন। তাঁরা কাজ করবেন বলে শপথ নিয়ে সরকারি কাজে যোগদান করেন। আর মানুষের অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে কুক্ষিগত করেন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পদ।

রাজনৈতিক বর্গিরাও এই সমাজের বোঝা। কোনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব দলের কোনো পদ নিয়ে, নির্বাচিত হয়ে অথবা অনির্বাচিতভাবেই নিজ নিজ এলাকার ত্রাণকর্তা সেজে বসে আছেন। এলাকার সব ধরনের ঠিকাদারি কাজ, উন্নয়নমূলক কাজ, নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্যের সব কাজেই তাঁদের হাত বাড়ানো চাই।

ধর্ম ও সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি পুঁজি করে, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে একশ্রেণির ধর্মব্যবসায়ী ধার্মিক বর্গি সেজে সমাজকে শাসন ও শোষণ করছেন।

সাধারণ শ্রমিক জনতা, সৎ রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ দেশপ্রেমিক, আপামর জনগণ যদি জেগে ওঠে, তবে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার শীর্ষ ব্যক্তি বোধ হয় এখনো সঠিক লাইনে আছেন। আশা করব, এই দুরবস্থার পর তিনি সঠিক নেতৃত্ব দিয়ে, যোগ্য-মেধাবী-সৎ লোককে সঠিক জায়গায় বসিয়ে নব্য বর্গিদের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করবেন।

আব্দুর রাজ্জাক, প্রকৌশলী

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ