১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকেই খাকি পোশাকের লোকজনদের আনাগোনা বেড়ে গেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ক্যাম্পাসের রাস্তায় তখন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী নেই। হাঁটছে শুধু সেনা সদস্যরা। পরিবারসহ গৃহবন্দী হয়ে থাকাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। নাজিম মাহমুদ আপাতত সে কাজটাই করলেন। স্বেচ্ছা গৃহবন্দী থাকলেও মন তো মানে না। জানতে চায় দেশের খবর। নব ঘুরিয়ে রেডিও পাকিস্তান ধরলেই শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন সতর্কবাণী, ঔদ্ধত্যময় কথাবার্তা। ‘শেখ মুজিব দেশদ্রোহী’, ‘শেখ মুজিব বন্দী’—এ কথাগুলো ভেসে আসছে রেডিও পাকিস্তান থেকে।
সন্ধ্যাবেলা আকাশবাণী কলকাতা থেকে একটি ছোট্ট মেয়ের কান্নাভেজা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…’।
নাজিম মাহমুদের মুখে কোনো কথা নেই। মুখে কথা নেই পরিবারের কোনো সদস্যের কণ্ঠে। কী এক অব্যক্ত বেদনায় ভরে যাচ্ছে সবার মন। ঠিক এ সময় অনেক দূর থেকে শোনা গেল একটা গুলির আওয়াজ।
সেই রাত থেকেই শুরু হলো বিনিন্দ্র রজনী কাটানোর পালা।
২৭ মার্চ ভিসির অফিসে নাজিম মাহমুদসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা হাজির হলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম স্বাভাবিকভাবে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই জরুরি তলব। ঢাকায় কী ঘটেছে ২৫ মার্চ রাতে, সে খবর একটু একটু করে আকাশবাণীর মাধ্যমে এসে পৌঁছেছে রাজশাহীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হত্যা করা হয়েছে, সে খবর জেনে নির্বাক সবাই।
কিন্তু ‘যেন কিছুই ঘটেনি’—এ রকম একটা মেকি ভাব নিয়ে সবাই কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এমন এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবদুল রহিম জোয়ারদারের ছেলে বাবু এসে বললেন, তাঁদের আত্মীয় রাজশাহীর আইনজীবী আবদুস সালামের দুই ছেলেকে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানি সৈন্যরা, এতক্ষণে নিশ্চয় তাঁদের মেরে ফেলেছে।
জোয়ারদার সাহেব ‘আমি বাড়ি আসছি’ বলে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত ‘সব কুছ ঠিক হ্যায়’ ধরনের যে চেহারা করে রেখেছিলেন সবাই, সেই মেকি চেহারাটা আর ধরে রাখা গেল না।
সূত্র: নাজিম মাহমুদ, যখন ক্রীতদাস, স্মৃতি ’৭১, পৃষ্ঠা: ১৬-১৮