বাংলার ধুলোবালিতে রত্ন। এই সত্যটি প্রমাণিত হয়েছে অনেক বছর আগে। তবে কথাগুলো কোনো প্রত্নতাত্ত্বিকের নয়, অতিসাধারণ যুদ্ধলিপ্সু শাসকদের। তাই লুটপাট শুরু হতো এখান থেকে। আলিবর্দী খাঁর সময় মহারাষ্ট্রের বর্গিরা বাংলায় অসংখ্যবার হানা দিয়েছে। লুটপাট করে চলে গিয়ে আবার হানা দিয়েছে। এই নিষ্ঠুর হামলা থেকে রক্ষা করেই আলিবর্দী খাঁ একজন আদর্শ শাসক হিসেবে মর্যাদা পান। তারও আগে রাজমহল থেকে ঢাকায় রাজধানী স্থানান্তর করতে হয়েছে ওই লুটেরাদের হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য। এর আগে আকবরের সময় একবার মাত্র বার ভূঁইয়াদের স্বাধীনতাসংগ্রাম হয়েছিল।
ধূলিঝড়, ধুলোবালিতে আমরা যথেষ্ট আক্রান্ত। তাই এর মধ্যে রত্ন লুকিয়ে আছে, বিষয়টি বুঝতে পারিনি। যথেষ্ট বোকা বলেই বুঝতে পারিনি। কারণ, পত্রপত্রিকায় কয়েক বছর ধরেই এই রত্নের কথা লেখা হচ্ছে। এই রত্নকে নিয়ে কত মারামারি, চর দখল, প্রশাসন, রাজনীতিক, সবার সংবাদ নিয়মিত ছাপা হচ্ছে। এই নিয়ে আবার রাজনীতিতে বড় বড় তৎপরতার খবরও নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি আমি গ্রামের দিকে গিয়েছিলাম। গ্রাম মানে আমার বাল্যকাল ও কৈশোরের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো দেখতে প্রায়ই ইচ্ছে করে। গ্রাম একদা ছিল বটে কিন্তু কোথাও এখন আগের সেই গ্রামের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আমার বালকবেলায় গ্রামের মধ্য দিয়ে একটা পিচঢালা পথ ছিল। দুটি বাস চলত। পথের পাশে একটা টংঘর। একেবারেই চারটি পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে একটা চায়ের দোকান। সঙ্গে টোস্ট বিস্কুট পাওয়া যেত। একটা কলসিতে তৃষ্ণার্ত পথিকের জন্য কিছু পানি। পানির উৎসও ছিল পুকুর। যেখানে একটা টিউবওয়েল পত্তন করতে ১০ বছর লেগে গিয়েছিল। সেখানে এখন শত শত দোকান, রেস্টুরেন্ট, বিশাল বাজার। রাস্তা প্রশস্ত, লাখো মানুষের আনাগোনা। একটা ভাঙাচোরা প্রাইমারি আর হাইস্কুল থেকে আরও স্কুল আরও কলেজ, সুদৃশ্য শপিং মল, সুপার মার্কেট। পাশে একটা স্রোতস্বিনী ছিল। বেশ খরস্রোতা, বর্ষায় পাড়ও ভাঙত। সেই স্রোতস্বিনী এখন দূরে সরে গিয়েছে। তার ভেঙে যাওয়া সেই তপ্ত বালুচর সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে অনেকের জীবনে। সেই তপ্ত বালুচর থেকে উঠে আসছে বালু। ধু ধু বালুচর দেখে বোঝা যায়, কয়েক বছর আগেও এখানে একটা স্রোতস্বিনী ছিল। ড্রেজারের হামলায় সেই পানিটুকু সরে গিয়ে বালু উঠতে শুরু করেছে। দেখে মনে হয়, পিরামিডের মতো উঁচু বালুর পাহাড়। ওপর থেকে ছবি তুললে পিরামিডের মতোই মনে হবে। এখন তার নামকরণও পাল্টে গেছে। এখন তার নাম বালুমহাল। একসময় নদীর জলাশয়গুলোর নাম ছিল জলমহাল। আজ জলমহাল উঠে গিয়ে নাম হয়েছে বালুমহাল। একদা প্রকৃতিপ্রদত্ত ব্যক্তিমালিকানাধীন যেকোনো সম্পদের মালিক ছিল রাষ্ট্র। বন-পাহাড়-নদীর মালিকানায় আজও আছে রাষ্ট্র। আর রাষ্ট্র পরিচালনায় আছে সরকার। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে এসব পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। আর প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা আইনগত বিষয়গুলো দেখভাল করবেন। এখন সব একাকার। প্রাচীন যুগের নিয়ম অনুসারে সাংসদ, ঠিকাদার, আমলা এবং এলাকার পেশিবহুল ব্যবসায়ীরা এর মালিক। খবরের কাগজে তাই সব সময় দেখা যায় এর দখল নিয়ে অনবরত মারামারি, খুনখারাবি চলছে। নতুন নতুন ইতিহাস তৈরি হচ্ছে। একেবারেই বিত্তহীনেরা কত দ্রুত ধনী হচ্ছে, তা একেকটা ঘটনা রীতিমতো আলিবাবার কাহিনি। অবশ্য আলিবাবার চল্লিশ চোরকে টেক্কা দিয়ে হাজার হাজার চল্লিশ চোর তৈরি হয়েছে।
একসময় পিরামিড শেষ হলো। পিরামিডের চিত্র দেখার পালা শেষে দালানকোঠা, মোটরসাইকেলের অকারণ আনাগোনা এবং বিত্তের দম্ভ দেখার পর আমি ৬০ বছর আগের আমার শিক্ষক, গ্রামীণ চিকিৎসক, কালীমন্দির আর আমার বয়সী বন্ধুদের খোঁজে বেরোলাম। বন্ধুরা তো দূরের কথা, সেই বাড়িঘরও দেখতে পেলাম না। অধিকাংশ দখল হয়ে গেছে। সামান্য কিছু বিক্রিও হয়েছে। আরেকটু পেরোলেই অন্য একটা নদী। বালু পরিবহনের জন্য স্রোতস্বিনীটিকে রুখতে হয়েছে। ওপরে একটা ব্রিজ, বেশ কয়েক বছর ধরেই অসমাপ্ত আছে। মাত্র ৮-১৯ ফুট মেরামত হলেই ব্রিজটির ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল করতে পারে। কয়েক বছর ধরে এলাকার মাননীয় সাংসদ বিষয়টি নানা প্রতারণায় ঝুলিয়ে রেখেছেন। দুজন সাংসদের যৌথ হুমকিতে অসহায় হয়ে মানুষ সবকিছুই মেনে নিয়েছে।
যা হোক, কাঠের পাটাতন বিছানো পথ দিয়ে ব্রিজে গিয়ে উঠলাম। শুনলাম, ওই পাটাতন দিয়ে ৮০ হাজার টাকা দামের একটা গরু পার করতে গিয়ে গরুটি নিচে পড়ে মারা গিয়েছে। গরুর জীবন কখনো মানুষের জীবনের চেয়েও মূল্যবান। কংক্রিটের ব্রিজে বসে দেখলাম, নিচে চলছে স্রোতস্বিনী। সেই যমুনার শাখা থেকে একেবারে ঢাকামুখী এই নদীটি। বালুর রত্নের অধিকারীদের জন্য এটা বড়ই প্রয়োজন।
সন্ধ্যা গাঢ় হতে শুরু করল। চারদিকে অন্ধকার। যদিও একটু দূরেই দেখা যাচ্ছে আলো। স্বাধীনতা দিবসের আলোকমালায় সেজেছে সব সরকারি ভবন। বিশাল সব অট্টালিকা, দামি গাড়ি, প্রশাসক, বিচারক, আমলাসহ সবার কী শানশওকতের জীবন। কিন্তু কি পাহারা দেওয়ার জন্য এত সব? দেশের অনেক মানুষই তো এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবন কাটাচ্ছে।
লেখক: নাট্যব্যক্তিত্ব