আমাদের প্রজন্ম যারা মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তী ও মুক্তিযুদ্ধকালের রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রত্যক্ষ করেছে, তাদের কাছে বেশ বেদনার অভিজ্ঞতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বর্তমান জাতীয় জীবনের পরস্পরবিরোধী শক্তির অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ববর্তীকালেও একটি গোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, শিক্ষা-সাংস্কৃতিক অধিকার অর্জনের লড়াই-সংগ্রামকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেনি। তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে নিয়ে অন্ধবিশ্বাসে বিভোর ছিল। সেই অন্ধত্ব মূলতই ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রচরিত্র সম্পর্কে তাদের আধুনিক জ্ঞানের অভাব। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব তাদের এতটাই আচ্ছন্ন করে রেখেছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ, নির্যাতন এবং পূর্ব বাংলাবিরোধী মনোভাবকে তারা তুচ্ছজ্ঞান করেছিল। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা এখানেই।
তারা আধুনিক রাষ্ট্রচরিত্রকে বুঝতে মোটেও বিশ্বাসী ছিল না। ইতিহাসের অগ্রযাত্রায় এরা তাই বাধা হয়ে ওঠা ছাড়া কোনো অবদান রাখতে পারে না। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শে বিশ্বাসী পাকিস্তানকালের রাজনৈতিক শক্তি স্রোতের বিপরীতে চলতে গিয়ে ক্রমেই দুর্বল হয়েছে। সে কারণেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাদের মাত্র দুজন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিল। তবে সারা দেশে তাদের ভোট ২০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল। এটি দ্রুত কমে গিয়েছিল নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে পাকিস্তানের পূর্ব বাংলাবিরোধী আচরণের কারণে। তিন মাসের মধ্যেই সংখ্যা অনেকটাই তলানিতে ঠেকেছিল। একাত্তরের মার্চ মাসে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি মোহমুক্তির সংখ্যা অনেক বেশি ঘটতে থাকে এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক স্রোত দ্রুত সম্প্রসারিত হয়ে ওঠে। মানুষের সম্মুখে তখন পাকিস্তানকে পরিত্যাগ করা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখার স্পৃহা জেগে ওঠে। রাজনৈতিক ঘটনার অভিজ্ঞতা এবং জাতিগত বোধ ও চিন্তার নবতর এক রূপান্তরের বিষয় হিসেবে এটি ঘটতে থাকে। সম্মুখে তখন তাদের কাছে বাঙালির নিজস্ব নেতৃত্ব আস্থার নতুন জায়গা তৈরি করতে সক্ষম হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অগ্নিঝরা মার্চের সেই দিনগুলোতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কান্ডারিরূপে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে উপস্থাপিত হন। তাঁর বক্তব্য ও স্বপ্ন দেখানোর ক্ষমতা মানুষকে সত্যি সত্যি উজ্জীবিত করেছিল। সে কারণেই মার্চ মাসের প্রতিটি দিন যেন জাতীয় ঐক্য গঠনের একেকটি স্তর পার করে চূড়ায় উপনীত হতে টেনে তুলে ধরেছিল। তেমন ইস্পাত কঠিন ঐক্য বাঙালির জাতীয় জীবনে এর আগে আর কখনো ঘটেনি। ২৫ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী অপারেশন সার্চলাইট নামে হত্যা শুরু করলেও জনগণ জাতীয় ঐক্য থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েনি কিংবা পাকিস্তানের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। বরং স্বাধীনতার দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা থেকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শুরু করে। প্রতিরোধের এই যাত্রা তিন সপ্তাহের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধের একটি বৈধ সরকার গঠনের মাধ্যমে নতুন ধাপে উন্নীত হয়। গোটা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অল্প কিছুসংখ্যক ব্যক্তি, গোষ্ঠী পাকিস্তানিদের দখলকৃত অঞ্চলে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিলেও বেশির ভাগ মানুষই ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে কিংবা সীমান্ত পার হয়ে উদ্বাস্তু জীবন বেছে নিয়েছিল। তাদের সামনে তখন ভরসার পারদ খুব বেশি ছিল না। যুদ্ধ করেই কেবল সেই পারদ ওপরে টেনে তুলতে হয়েছিল। লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আস্থাশীল হয়ে উঠতে থাকে। নানা প্রতিকূলতা, হতাশা, যুদ্ধবিগ্রহ, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, নারী ধর্ষণ ইত্যাদি কঠিন পর্ব অতিক্রম করে মানুষ জাতীয় ঐক্যকে আরও যেন শাণিত করে তুলেছিল। ক্রমেই এই ঐক্য পাকিস্তানিদের চারদিক থেকে আক্রমণ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এমন দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ ও উৎসর্গ করার মনোবৃত্তিই মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের চূড়ান্ত প্রান্তে নিয়ে আসে। ১৬ ডিসেম্বর যে বিজয় সূচিত হয়েছিল, তা ছিল বাঙালি জাতির সূচিত ঐক্যের সুফল। তখন স্বাধীনতার এই সুফল লাভের বিরুদ্ধে পরাজিতের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য।
দলগতভাবে এরা ছিল জামায়াত-এ-ইসলাম, নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপি নামক কয়েকটি রাজনৈতিক দলের মুষ্টিমেয় কিছু নেতা ও সমর্থক।
এদের সংখ্যা তখন গণনার মধ্যেও উল্লেখ করার মতো তেমন একটা ছিল না। নেতাদের কেউ কেউ পালিয়ে পাকিস্তানে কিংবা বিদেশে চলে যায়। কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই পরাজিত হয়ে ধরা পড়ে কিংবা পালিয়ে আত্মগোপন করে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে অস্বীকার করার মতো তাদের কোনো নৈতিক ক্ষমতা ছিল না। পাকিস্তানকেও তারা এই ভূখণ্ডে আর টিকিয়ে রাখতে পারেনি। ব্যর্থতার গ্লানি তাদের কতখানি জনবিচ্ছিন্ন করেছিল, সেটি তাদের দৃশ্যপট থেকে হারিয়ে যাওয়া থেকেই বুঝতে হবে। স্বাধীন রাষ্ট্রের বিরোধিতার পরিণতি তখনই কেবল তারা অনুভব করতে সক্ষম হয়। আবার বাংলাদেশেই তাদের থাকতে হয়েছে।
১৯৭২ সালে রাজনৈতিক মতাদর্শগত ভিন্নতা ধীরে ধীরে জন্ম নিতে থাকে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখন একাত্তর সালের সূচিত ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্যকে ধরে রাখার গুরুত্বপূর্ণ একটি পর্বের কথা অন্তর্দৃষ্টি ও রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসবোধ দিয়ে অনুভব করতে পারেনি। জাতীয় ঐক্যের বিপর্যয় ঘটলে পরিণতি কী হতে পারে, সে বিষয়ে সজাগ কেউ থাকেনি। ফলে ধীরে ধীরে জাতীয় ঐক্যের মধ্যে রাজনৈতিক ফাটল ছোট ছোট আকারে জন্ম নিতে থাকে। এখানে আবেগ, উচ্ছ্বাস, রোমান্টিকতা, হঠকারিতা, স্বার্থপরতা এবং ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক জীবনে যেসব পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনা ও বিশ্বাসের অবশিষ্টাংশ ক্রিয়াশীল ছিল, সেগুলো দ্রুতই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর প্রসারিত হতে থাকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা সংগ্রাম, ত্যাগ এবং জীবনের অনেক ঝুঁকি নিয়েছিল, তারাই নতুন পরিস্থিতিতে কীভাবে জাতীয় ঐক্যকে রাষ্ট্র বিনির্মাণে পুনর্গঠিত করার প্রয়োজন ছিল, তা উপলব্ধি করতে পারেনি। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে জাতীয় ঐক্য গুরুত্ব হারায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর নিকটজনদের নৃশংস হত্যার পর রাষ্ট্রক্ষমতায় যে শক্তির উত্থান ঘটে, তার চরিত্র নিরূপণ করতে অনেকেই তাৎক্ষণিকভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। অথচ এমন বিয়োগান্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে ১৯৭১-এর পরাজিত শক্তির পুনরাবির্ভাব ঘটার পথ দেশে খুলে দেওয়া হলো। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী প্রধান নেতাদের কয়েকজন, মুক্তিযোদ্ধা এবং সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় নতুন একটি প্ল্যাটফর্ম। এতে সমবেত হয় স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় ঐক্য এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূল আদর্শবিরোধী সব পক্ষ। এটি কালক্রমে রাষ্ট্র, সমাজ, রাজনীতি, প্রশাসন ও জনজীবনে এমন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে, তা তখন অনেকেই উপলব্ধি করতে পারেনি।
বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে তখন জামায়াত আবার ফিরে আসে। রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে শাসকগোষ্ঠী এসব অপশক্তিকে রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে প্রশ্নের সম্মুখীন করে ফেলে। অন্যদিকে প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে অসাম্প্রদায়িক জাতি-রাষ্ট্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক শক্তির পুনরুত্থানকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল। দেশের রাজনীতিতে বাম গণতান্ত্রিক শক্তিও জাতীয় প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারেনি, রাজনৈতিক চিন্তা আগের চেয়ে আরও বেশি বিভাজিত ও সংকীর্ণ হতে থাকে। গত ৫০ বছরে রাজনীতির বিভাজন পরস্পরবিরোধী দুটি ধারায় জাতিকে বিভক্ত করেছে। আশির দশকে সামরিক শাসক এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে তিনটি রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়েছিল। একটির মূল নেতৃত্ব দিয়েছিল বিএনপি, সঙ্গে ছিল জামায়াত এবং ছোট ছোট কিছু রাজনৈতিক দল। বিপরীত দিকে অবস্থান করেছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন একটি জোট, যা পরে দুটি জোটে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৯১-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বাম জোট গণতন্ত্র উত্তরণে ঐক্যবদ্ধ কোনো কৌশল প্রণয়ন করতে পারেনি। বিপরীত দিকে বিএনপি জামায়াতের সঙ্গে গোপনে নির্বাচনী ঐক্য গঠন করে। ফলে তাদের অদৃশ্য ঐক্য বিজয়ের সাফল্য নিয়ে আসে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় নির্বাচিত সংসদ ও সরকার হিসেবে বিএনপি ও জামায়াত নেতৃত্ব প্রদান করে। আওয়ামী লীগ ও বাম শক্তি বিরোধী দলে অবস্থান করতে বাধ্য হয়। ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করার মতো তাগিদ গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনুভূত হয়নি। ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি ও ইসলামী ঐক্যজোটের নেতৃত্বে চারদলীয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জোট গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ দেশ পরিচালনায় সেই মেয়াদে বড় ধরনের সাফল্য দেখালেও গঠিত চারদলীয় জোটের কাছে ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হয়। বাংলাদেশে বিএনপি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোটের একটি মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চরম ডান পন্থার সরকার গঠিত হয়। দেশে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতে অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে হত্যা, বোমাবাজি ইত্যাদি চালিয়ে বেড়ায়। রাজনীতিতে আবারও ১৫ আগস্টের মতো ক্ষত ও বিভাজন স্থায়ী রূপ লাভ করে।
বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও তোষণ করার অবস্থান থেকে এক চুলও নড়েনি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, অসাম্প্রদায়িক ধারার নেতৃত্ব প্রদান করতে গিয়ে ২০১৩-১৪ পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু নীতি ও কৌশলে পরিবর্তন ঘটায়। এর ফলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক দায়িত্ব এই সময়ে উপেক্ষিত হয়েছে। ফলে দেশ এখন এক দিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের একটি ধারায় পরিচালিত হচ্ছে, অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত ও সাম্প্রদায়িক শক্তির সমন্বয়ে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ধারায় জাতীয় ঐক্য সম্পূর্ণরূপে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে। এর পরিণতি জাতি-রাষ্ট্রের জন্য মোটেও মঙ্গলজনক নয়।
লেখক: মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী, অধ্যাপক, ইতিহাসবিদ ও কলামিস্ট