এখন ইলিশের ভরা মৌসুম। বাজারে হাইব্রিড মাছের ছড়াছড়ি। আছে আমদানি করা মাছও। কিন্তু ইলিশ মাছ মানসম্মত সাইজ অনুযায়ী পাওয়া যায় না। ২৫০ থেকে বড়জোর ৫০০ গ্রামের ঊর্ধ্বে ইলিশ মেলা ভার। সে কারণে ইলিশ কেনা ছেড়ে দিয়েছি। কিন্তু পরিবারের পীড়াপীড়িতে এবং ইলিশ কেনার দাপাদাপিতে বাজারে গিয়েছিলাম। মাত্র দুই-তিনজন বিক্রেতার কাছে সর্বোচ্চ এক কেজি ওজনের ইলিশ মাছ পেলাম। সংখ্যায়ও কম। তবে দাম শুনে আঁতকে উঠেছি।
একদাম ১ হাজার ৫০০ টাকা প্রতিটি এক কেজির ইলিশ। বহু চেষ্টা করেও দর কমানো সম্ভব না হওয়ায় অগত্যা একটি ইলিশ কিনে বাসায় ফিরেছি। টেনেটুনে সেটি একবেলায় হয়ে যাবে। পরিবারের সবার দীর্ঘদিনের চাহিদা পূরণে একধরনের তৃপ্তি অনুভব করলেও এক কেজির ইলিশ ১ হাজার ৫০০ টাকায় কিনে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে বিলম্ব ঘটেনি। এটা তো রীতিমতো অর্থনাশের শামিল হলো। যে ইলিশটি ১ হাজার ৫০০ টাকায় কিনেছি, এই সাইজের ইলিশ চার-ছয় আনায়ও কিনেছি, সেই অতীতে। অতীত আর বর্তমানের খাদ্যপণ্যের দরের তারতম্য কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে! নিয়মিত বাজার করি বলেই খাদ্যপণ্যের বাজার-অর্থনীতি সম্পর্কে আমার ধারণা খুব পরিষ্কার। তবে এক কেজি ইলিশ এই ভরা মৌসুমে এত দামে কিনে আত্মগ্লানিতে পড়েছি আমি। এ নিয়ে একধরনের অপরাধবোধও ভেতরে-ভেতরে আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। যেটা গৌরবের তো নয়ই, রীতিমতো লজ্জা ও অনুশোচনার।
সম্প্রতি এক আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় জানতে পেরেছি, বিশ্বে সর্বাধিক ইলিশ উৎপন্ন ও আহরণের জন্য বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম স্থানে। অন্য কোনো ক্ষেত্রে আমাদের অমন অর্জন নেই। বরাবর অবস্থান তলানিতেই। ইলিশ উৎপন্নের সেরা দেশটিতে এক কেজি ইলিশের দর কীভাবে ১ হাজার ৫০০ টাকা হয়? বাজারের সিংহভাগ ইলিশ তাহলে কেন ২৫০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের দেখা যায়? বড় ইলিশ বাজার থেকে উধাও কেন? কোথায় যায় সর্বোচ্চ উৎপন্নের দেশের ইলিশ? প্রশ্নগুলো অমূলক বিবেচনার সুযোগ নেই। খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। মাঝে মাঝে জানা যায়, বাংলাদেশের পদ্মার ইলিশে সয়লাব পশ্চিম বাংলার বাজার। কথাগুলো আমলে নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। কিন্তু সম্প্রতি ইলিশ কেনার ভয়াবহ অভিজ্ঞতা আমাকে সেই ভাবনার দিকেই ঠেলে দিয়েছে।
মনে পড়ে, গত শতকের সত্তর ও আশির দশকে কলকাতায় ভ্রমণে গিয়ে সেখানকার বাঙালিদের মুখে পদ্মার ইলিশের আহাজারি শুনতাম। বিমানে গেলে ইলিশ মাছ ভেজে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাও আমার রয়েছে। ইলিশ মাছের কথায় তাঁদের চোখে-মুখে অতৃপ্তির ভাব ফুটে উঠত। ইলিশবঞ্চিত কলকাতার বাঙালিদের হতাশার অভিব্যক্তি তাঁদের কথায়-আচরণে প্রকাশ পেত; বিশেষ করে দেশভাগে ভিটেমাটি ত্যাগ করে জীবন বাঁচাতে পশ্চিম বাংলায় স্থায়ী হওয়া বাঙালিদের ক্ষেত্রে সর্বাধিক দেখেছি। যাঁরা আমাদের ভাগ্যবান এবং নিজেদের দুর্ভাগা বলতে দ্বিধা করতেন না। ইলিশের জন্য তাঁদের আদিখ্যেতায় বিরক্তই হতাম। অথচ কী ভবিতব্য, আজকের বাস্তবতায় আমরা তাঁদের এবং তাঁরা আমাদের ভাগ্যবরণ করেছে।
আমাদের সরকার বন্ধুত্বের প্রতিদানস্বরূপ দেশে উৎপন্ন বড় আকৃতির ইলিশ ভারতে রপ্তানি করে চলেছে। যার রপ্তানিমূল্য দেশের বাজারের মূল্যের তুলনায় অনেক কম। আমদানিকারক দেশ হিসেবেই আমাদের খ্যাতি সর্বাধিক। ইলিশ রপ্তানির গৌরবের মহিমায় রপ্তানিকারক দেশের সুনামও বোধকরি অর্জনের অছিলায় বন্ধুত্বের এই অকৃত্রিম অর্থনৈতিক ত্যাগ! ইলিশ রপ্তানিতে বৈদেশিক মুদ্রা আসছে। এটাও আমাদের জন্য গৌরব ও সান্ত্বনা নিশ্চয়ই। জলের মূল্যে ইলিশ রপ্তানিতে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বন্ধুত্বের অকৃত্রিম মহানুভবতায় দেশবাসীকে ইলিশবঞ্চিত করে সরকার বন্ধুরাষ্ট্রের বাহবা-কৃতজ্ঞতা কুড়াচ্ছে। সেটাও সরকারের জন্য কম কিসে! সেটাও উন্নয়নের, অর্থাৎ সম্পর্ক উন্নয়নের অর্জন তো বটেই।
আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। এটাই আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য-সংস্কৃতি। ইলিশ আমাদের জাতীয় মাছের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু সেই মাছ নগণ্য মানুষই কিনে খাওয়ার যোগ্যতা রাখে। সমষ্টিগত মানুষের পক্ষে ইলিশ কেনা অসাধ্য কেবল নয়, অসম্ভব এখন। দেশবাসীকে বঞ্চিত করে ইলিশ রপ্তানি নিশ্চয় সঠিক বলা যাবে না। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানিতে কারও আপত্তি হতো না। জনগণের ন্যায্য দাবি উপেক্ষার সংস্কৃতি প্রতিটি সরকারের ক্ষেত্রে আমরা দেখে এসেছি। বর্তমান সরকারও ব্যতিক্রম নয়। ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র। ভারত কি নিজেদের চাহিদা অপূর্ণ রেখে অতীতে বাংলাদেশে চাল রপ্তানি করেছিল? করেনি। কোনো দেশপ্রেমিক সরকার নিজ দেশের জনগণকে বঞ্চিত করে এটা করতে পারে না। সে কারণে ঢাকার তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন (যিনি পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরের বাসিন্দা ছিলেন) দ্বিধাহীন মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমাদের জনগণকে না খাইয়ে, বঞ্চিত করে আমরা বাংলাদেশকে চাল দিতে পারব না।’ তাঁর সেই কথায় দেশবাসী তীব্র ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছিল। কিন্তু তাঁর কথা ন্যায্য ছিল। পরে ভিয়েতনাম থেকে চাল আমদানি করে খাদ্যসংকট এড়ানো সম্ভব হয়েছিল।
ইলিশ মাছের ক্ষেত্রে আমাদের সরকার যদি একই অবস্থান নিতে সক্ষম হতো, তাহলে সেটা দেশপ্রেমিক সরকারের যোগ্য ভূমিকারূপেই গণ্য হতো। কিন্তু সরকার সেটা করেনি। বিপরীতে দেশের মানুষকে ইলিশবঞ্চিত করে ভারতে জলের মূল্যে ঢালাও ইলিশ রপ্তানি করে যাচ্ছে। অপর রাষ্ট্র যত বন্ধুই হোক, জনগণের খাদ্য-সম্পদ তাদের হাতে নির্বিচারে তুলে দেওয়া দেশপ্রেমের নজির নয়; বরং দেশ ও জনবিরোধী নজির হিসেবে ইতিহাসে অন্তর্ভুক্ত হবে।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত