হোম > ছাপা সংস্করণ

আলোর পরিস্ফুটনেই কুয়াশা কাটবে

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

মৌলবাদী জঙ্গিরা কেবল বেকার নয়, মাদ্রাসা-শিক্ষিতও বটে। বেকারত্ব এবং মাদ্রাসাশিক্ষার ভেতর খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। গরিবের ছেলেমেয়েরা মাদ্রাসায় যায়, গিয়ে বেকার হয় এবং তাদেরই একাংশ হতাশাগ্রস্ত অবস্থায় জঙ্গি তৎপরতায় যোগ দেয়। এই মাদ্রাসাশিক্ষায় বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ চলছে এবং এর বড় ভাগ আসছে আমাদের বিদেশি শত্রুদের কাছ থেকে। এই বিনিয়োগে স্থানীয়রাও অংশ নেয়; কেউ নেয় না-বুঝে, অধিকাংশই নেয় পুণ্য ও সুনামের আকাঙ্ক্ষায়। সরকারগুলোও দেখা যায় মাদ্রাসা শিক্ষায় যত উৎসাহ বোধ করে, মাধ্যমিক শিক্ষার বেলায় ততটা নয়। তাতে পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায় যে এরা আর যা-ই হোক দেশপ্রেমিক নয়। শিক্ষা দেওয়ার নাম করে এরা অনুগত ও পঙ্গু মানুষ উৎপাদনে আগ্রহী।

বর্তমান সরকার অবশ্য আরও একধাপ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে, তথাকথিত ‘একমুখী’ শিক্ষা প্রবর্তনের নাম করে তারা মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাকে মাদ্রাসার স্তরে ঠেলে নামিয়ে মাধ্যমিক ও মাদ্রাসাশিক্ষার একটি ‘সমন্বয়’ ঘটানোর পদক্ষেপ নিয়ে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রেও মস্ত বড় বিনিয়োগ তারা ঘটিয়েছে।

আমরা একমুখী শিক্ষা অবশ্যই চাই; কিন্তু সেই একমুখী শিক্ষা হচ্ছে ইংরেজি, বাংলা এবং মাদ্রাসা—এই যে তিন ধারার শিক্ষা, এগুলো এক করার এবং সেই একত্রীকরণের ভিত্তিতে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠা করার। ‘মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা’ যেকোনো শিক্ষাব্যবস্থারই প্রথম কথা হওয়া দরকার; আমাদের সংবিধানেও ওই ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার রয়েছে। কিন্তু যা গড়ে উঠেছে তা হলো তিনমুখী ব্যবস্থা; সরকার চাইছিল তিনমুখীকে দুইমুখী করতে, যার একটি হবে ইংরেজি মাধ্যমের অপরটি মাধ্যমিক+মাদ্রাসার। সমাজে যেমন ধনী ও দরিদ্র এই দুই শ্রেণির বিভাজনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চলছে, শিক্ষাক্ষেত্রকেও তেমনি সেই চেষ্টারই অংশ হিসেবে ব্যবহার করাটা ছিল সরকারের অভিপ্রায়। ওদিকে ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক সামাজিক বিনিয়োগ ঘটেছে এবং তা ক্রমাগত বাড়ছে। এই শিক্ষা পেয়ে যারা বেরিয়ে আসছে এবং আগামীতে আসবে, তারা হবে ফাঁপা ও উৎপাটিত। বাবা-মা পয়সা ঢেলে এ রকমের কৃত্রিম মানুষ তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন।

দেশে ধর্মীয় মৌলবাদীরা ক্রমাগত মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। বর্তমান সরকার তাদের এত দিন নানাভাবে লাই দিয়ে এসেছে, এরা একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং আগামীতে সেভাবেই তৎপরতা চালাবে। সরকারের দৃষ্টিতে বিএনপিই মনে হয় একমাত্র শত্রু। আসলে কিন্তু বিএনপি হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী, শত্রু হচ্ছে ধর্মীয় মৌলবাদীরা। বিএনপি এখন বেশ অসুবিধায় আছে, সরকার মনে হয় তাদের আরও জব্দ করতে চায়; কিন্তু বিএনপি সরে গেলে তার শূন্যতাটা ভরার জন্য যে হেফাজত আসার সম্ভাবনা, সেটাকে সরকার মনে হয় বিবেচনায় নিচ্ছে না। পশ্চিমবঙ্গে তো ঠিক এ রকমটাই ঘটেছে। তৃণমূল এমনই ব্যবস্থা করেছে যার দরুন শূন্য স্থানে কংগ্রেস বা সিপিএম কেউই নেই, জায়গাটা বিজেপি দখল করে নিয়েছে, কংগ্রেস ও বামপন্থীদের ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে।

হেফাজতের বর্তমান নেতৃত্বের বড় দুর্বলতা নেতৃত্বের ভেতরেই রয়ে গেছে, সেটা হলো মুনাফালিপ্সা ও ভোগলালসা। কিন্তু হেফাজতের জন্য খুব বিস্তৃত একটা লালনভূমি তো সমাজে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে রয়েছে লাখ লাখ মাদ্রাসা-শিক্ষিত মানুষ, যাদের জন্য জীবিকার পথ উন্মুক্ত নয়, অনেকেই বেকার কিংবা অর্ধ-বেকার এবং স্বভাবতই বিক্ষুব্ধ; তাদের সঙ্গে জামায়াতের লোকেরা যদি যুক্ত হয়, তবে সেটা মোটেই শুভ ঘটনা হবে না। আইএসের বিক্ষিপ্ত তৎপরতা আমাদের দেশে যে দেখা দেয়নি তা নয়। আইএস ইরাক থেকে বিতাড়িত হয়েছে, তবে এরা যে কতটা কট্টরপন্থী ও নৃশংস হতে পারে তার প্রমাণ সেখানে তারা বেশ ভালোভাবেই রেখে এসেছে। এখন তারা চেষ্টায় থাকবে যেখানে সুবিধা, সেখানেই ঢুকে পড়ার। আফগানিস্তানে তাদের তৎপরতার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। কাবুলের কাছে মেয়েদের এক স্কুলের সামনে গাড়িবোমা ফাটানোর এক ঘটনায় ৬৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল, যাদের প্রায় সবাই স্কুলছাত্রী, আহত হয়েছিল আরও বহুজন। তালেবান এ কাজ করেনি বলেছে। সে অস্বীকৃতি অবিশ্বাসযোগ্য নয়। তাহলে কে করল? আইএস দায়িত্ব স্বীকার করেনি, কিন্তু এ নিয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই যে এটা আইএসেরই কাজ। এরা বাংলাদেশে ঢুকে পড়লে ভয়াবহ কাণ্ড যে ঘটাবে, তা নিশ্চিত।

ধর্মীয় মৌলবাদীদের লালনক্ষেত্রটি উর্বর থেকে উর্বরতর হচ্ছে। মাদ্রাসায় শিক্ষিত অসন্তুষ্ট মানুষেরা তো আছেই; সাধারণ মানুষের মধ্যেও দেখা দিয়েছে হতাশা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব। এ দেশের মানুষ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়েছে, তারা বড় রাষ্ট্র ভেঙে ছোট করেছে, কিন্তু তাদের মুক্তি আসেনি। জুলুমবাজি বড় হয়ে তাদের কাঁধে চেপে বসে আছে। ফলে এখন হতাশা দেখা দিয়েছে। মনোভাবটা হচ্ছে পরাজিতের। অন্যদিকে ব্যক্তি মানুষ দেখছে তার চারপাশে কেউ নেই—সমাজ নেই, রাষ্ট্র নেই, আপনজনেরাও নেই; নিজের ওপর তার আস্থা তাই কমে যাচ্ছে, সে ভাবছে ধর্ম ছাড়া তার জন্য অন্য কোনো আশ্রয় নেই, ভরসাও নেই। বাঁচান যদি তবে আল্লাহই বাঁচাবেন। আত্মবিশ্বাসহীনতা যত বাড়বে, মৌলবাদের চর্চা ততই শক্তিশালী ও ব্যাপক হবে। দেশে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা ক্রমাগত কমছে; উল্টো দিকে ওয়াজ, মিলাদে বক্তৃতা, ফতোয়া—এসব বেড়েই চলেছে। আবার এটাও তো না মেনে উপায় নেই যে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রকে যদি হিন্দু রাষ্ট্র করার চেষ্টা চলে, তবে তার প্রতিক্রিয়ায় ও অনুসরণে আমাদের রাষ্ট্রকে মুসলিম রাষ্ট্র করার প্রচেষ্টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে চাইবে।

আসল সত্যটা কিন্তু এই, এই সবকিছু হচ্ছে মূল যে ব্যাধি, যার নাম পুঁজিবাদ, তারই নানা ধরনের উপসর্গ। যে ইহুদিরা একদিন হিটলারের গণহত্যার শিকার হয়েছিল, যার নিন্দা বিশ্বব্যাপী এখনো শোনা যায়, তাদের রাষ্ট্র ইসরায়েল কেন অরক্ষিত ফিলিস্তিনিদের উৎখাত করছে এবং হত্যা করছে নির্মমভাবে? জবাবটা সোজা। সেটা হলো এই যে একজন হিটলার বিদায় হয়েছে ঠিকই, কিন্তু হিটলাররা ধ্বংস হয়নি; তারা আছে। হিটলার যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিনিধি ছিল ও রক্ষক সেজেছিল, সেই ব্যবস্থাটা ভাঙতে না পারলে হিটলাররা বিদায় হবে না।

ভরসা এই যে প্রতিবাদ হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের হামলে পড়ার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছে। খোদ আমেরিকায় জো বাইডেনের নিজের পার্টির ভেতরই তাঁর ইসরায়েলঘেঁষা নীতির বিরুদ্ধে ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বার্নি স্যান্ডার্স ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। নিজে তিনি ইহুদি বংশোদ্ভূত, কিন্তু ইসরায়েলের নীতির তিনি বিরোধী। ব্রিটেনে লেবার পার্টির জেরেমি করবিন প্রতিবাদ করেছেন এবং আগে যেটা কখনো শোনা যায়নি, সেটা এবার শোনা গেল। ইসরায়েলে যে আরবরা বসবাস করে তারা রাস্তায় বের হয়ে এসেছে। সংখ্যার হিসাবে এরা ওই রাষ্ট্রের নাগরিকদের শতকরা ২১ জন। কম নয়। কিন্তু নিষ্পেষণ এমন প্রবল যে তারা নিজেদের অধিকারের কথা এতকাল জোর গলায় বলতে পারেনি। এবার বলছে।

একটা শক্তিশালী আন্তর্জাতিকতা তৈরি হচ্ছে। যে জন্য মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ঘটলে বিশ্বে তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় এবং সেনা অভ্যুত্থানবিরোধীরা যখন রোহিঙ্গাদের বাদ দিয়ে নতুন ঐক্য-সরকার গঠন করে, বিশ্বের গণতান্ত্রিক মহলে তাতেও অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। আর এটাও তো তাৎপর্যহীন নয়, ঢাকার একজন সাংবাদিক যখন লাঞ্ছিত হন, তখন বহির্বিশ্বের মানবাধিকারকর্মীরা ও সাংবাদিকেরা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিবাদ জানান; এমনকি জাতিসংঘও উদ্বেগ প্রকাশ না করে পারে না।

কিন্তু যা দরকার তা হলো, বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদবিরোধী সুসংগঠিত ও ধারাবাহিক আন্দোলন। নইলে বিপদ আছে। সংকটগুলো সেই সতর্কবাণীই উচ্চারণ করে চলেছে। 
লড়াইটা কেবল উপসর্গকেন্দ্রিক হলে চলবে না, হতে হবে ব্যাধিকেন্দ্রিক। আর এই লড়াই কোনো একটি দেশের নয়, সারা বিশ্বের। মানুষের সভ্যতা এখন এক ক্রান্তিকালে এসে পৌঁছেছে; কোন দিকে সে মোড় নেবে, সেটা নির্ভর করছে মানুষের কর্তব্যপালনের ওপরই। কর্তব্যটা কেবল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা করার নয়, ট্রাম্পকে হটিয়ে বাইডেনকে আনার নয়; পুঁজিবাদকে মোকাবিলা করারই। এই সত্যটাকে অস্পষ্ট করার চেষ্টার কোনো কমতি নেই; কিন্তু সত্যটিকে আনা চাই সামনে। আলোর পরিস্ফুটন জোরদার হলে তবেই কুয়াশা কাটবে। নইলে নয়।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ