হোম > ছাপা সংস্করণ

কোথায় চলেছে দেশ, কোন পথে?

জাহীদ রেজা নূর

টিপ পরে রাস্তায় বেরিয়েছিলেন যে নারী শিক্ষক, তাঁকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছেন মোটরসাইকেলে বসে থাকা এক লোক। তিনি পুলিশের পোশাক পরা ছিলেন। তাই এটা মনে করা স্বাভাবিক যে তিনি পুলিশ বাহিনীরই সদস্য। শিক্ষক রুখে দাঁড়ানোয় তাঁর পায়ের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল চালিয়ে চলে গেছেন সেই লোকটি। মোটরসাইকেলের নম্বরটা জানা গেছে। তাঁকে খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত কাজ হবে বলে মনে হয় না। খুঁজে পেলে তাঁর হয়তো শাস্তি হবে—কিন্তু শাস্তি হলেও আসলে লাভ কী? মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রায় ধীরে ধীরে যে অসহিষ্ণুতা স্থান করে নিয়েছে, তা ক্রমেই ধর্মীয় উগ্রবাদের সঙ্গে মিলেমিশে যাচ্ছে, সেটা কি আমরা বুঝতে পারছি? এটি যে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, সমাজে এই অসুস্থ প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ছে, এদিকটায় এখনই নজর না দিলে মানুষের মনের মানবিক জায়গাটি ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।

একজন বাঙালি বা বাংলাদেশে বসবাসকারী নারী কপালে টিপ পরবেন কি পরবেন না, সেটা যে তাঁর একান্ত নিজস্ব ব্যাপার, সে কথা কে কাকে বোঝাবে?
 
দুই. 
বিষয়টি একটু তলিয়ে দেখা যাক।
নারীকে যুদ্ধ করতে হয় ঘরে-বাইরে—সর্বত্র। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতায় শুধু পুরুষের অধিকার আছে, তা নয়; পরিবারের নারীদেরও সেই মানসিকতায় গড়ে নেওয়া হয়। ফলে, সেই নারীরা তাঁদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হওয়ার সুযোগ পান না; বরং ময়না পাখির মতো শেখানো বুলিই তাঁদের সম্বল হয়। পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উন্মেষের পর থেকেই নারীকে অবদমিত করে রাখা হয়েছে। সে সময় থেকে সমাজের যে যে ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে, সে সে ক্ষেত্রে পুরুষেরাই হয়ে থেকেছেন একনায়ক। নারীকে তাঁর ভাগ্য গড়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। নারীরা থেকেছেন পুরুষদের সম্পত্তি হয়ে। শুধু পশ্চাৎপদ দেশেই নয়, নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার উন্নত দেশগুলোতেও নারীকে হেনস্তা হতে হয়।

নারী কোন পোশাক পরবেন, সেটা নারীই ঠিক করবেন।

যেকোনো দেশে পোশাক নির্ধারণ করা হয় আবহাওয়া ও সংস্কৃতিকে মনে রেখে। কখনো কখনো শাসকশ্রেণির পোশাকও জায়গা করে নেয় নাগরিকদের শরীরে। সেটাই কিন্তু আমরা দেখে এসেছি আজীবন। এককালে শুধু এক বস্ত্র পরিধান করতেন এই অঞ্চলে বসবাসকারী নারী-পুরুষ সবাই। এরপর মোগল অথবা সুলতানদের আগমনের পর তাঁদের দেশ থেকে আনা পোশাকে স্বচ্ছন্দ বোধ করত ওপরতলার মানুষেরা। ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজদের পোশাকই বেছে নিয়েছিল তারা।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, পোশাকের এই বিবর্তন মূলত ঘটেছে সমাজের উপরিস্তরে। দেশের গরিব মানুষের এখনো প্রধান পোশাক লুঙ্গি অথবা ধুতি। প্রচণ্ড গরমে পুরুষেরা গায়ে গেঞ্জিও পরেন না। নারীরা এক প্যাঁচে শাড়ি পরেন। পোশাকে বৈচিত্র্য মূলত আসে শহুরে মানুষের মধ্যে, তারপর একটু একটু করে তা ছড়িয়ে যায় গ্রামের দিকে।

সমাজে কোন সংস্কৃতি প্রবল, তার ওপর নির্ভর করে পোশাক-আশাক। চলচ্চিত্র, নাটক, সংগীত, নৃত্য ইত্যাদি তথা সংস্কৃতিজগতের সঙ্গে মানুষের প্রত্যক্ষ সংযোগ মানুষের মন ও পোশাকের ক্ষেত্রেও প্রভাব ফেলে। সেগুলো যদি সাংস্কৃতিক জীবন থেকে হারিয়ে যেতে থাকে কিংবা সুকৌশলে সেগুলোকে যদি সাংস্কৃতিক জীবন থেকে বিদায় করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করা হয়, তাহলে এ ধরনের উগ্রপন্থী মনোভাব গোটা সমাজে ছড়িয়ে যেতে পারে। 

তিন. 
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের প্রত্যয় কী ছিল, সেটা জেনে নেওয়া যাক। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্পষ্ট অক্ষরে লেখা আছে, ‘বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করা’ এই রাষ্ট্রের লক্ষ্য হবে। তার মানে এই রাষ্ট্রে যারা বসবাস করবে, তারা যে ধর্মের মানুষই হোক না কেন, রাষ্ট্রের চোখে তারা সমান, তাদের মানবিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকবে এবং সামাজিকভাবে তারা কেউ সুবিচার বঞ্চিত হবে না।

বাংলাদেশের সংবিধানে আমরা পেয়েছিলাম আরও কয়েকটি শব্দ: জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

কোনো এক অদ্ভুত কারণে এ দেশের বহু মানুষ ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির অর্থ হৃদয়ে ধারণ করতে পারে না। তারা মনে করে, এ শব্দটি বুঝি নাস্তিকতার সঙ্গে যুক্ত। এই ভুল ব্যাখ্যাটি শহরে-গ্রামগঞ্জে—সর্বত্রই সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেক্যুলারিজম শব্দটিকে নাস্তিকতার প্রতিশব্দ হিসেবে দাঁড় করিয়ে ফেলা হয়েছে। অথচ শব্দটিকে অসাম্প্রদায়িকতা হিসেবে অনুবাদ করলে হয়তো মতলববাজেরা এভাবে গোটা জাতিকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পেত না। 
সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে দেখতে পাচ্ছি, 
‘১২। ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য, 
(ক) সর্ব প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, 
(খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান,
(গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, 
(ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।’

এই বাক্যগুলোকে আমি খুব জরুরি বার্তা বলে মনে করছি। টিপ পরা নিয়ে সেই মানুষ নামের দুর্বৃত্তটি একজন শিক্ষকের সঙ্গে যে কাণ্ডটি ঘটিয়েছেন, তা যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা থেকে, সে কথা বুঝতে হলে রকেটবিজ্ঞানী হতে হয় না। শুধু তা-ই নয়, তিনি যে নিজের আত্মপরিচয়ও ভুলে গেছেন, সেটা বললেও বুঝি ভুল হয় না।

সংবিধানে বর্ণিত এই শব্দগুলো মানুষের মনে দৃঢ়ভাবে ঠাঁই নিতে পারছে না কেন, সে ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে এই শব্দগুলোকে সরলভাবে বোঝা দরকার।

প্রথমত, এই রাষ্ট্রে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতা থাকতে পারবে না, অর্থাৎ প্রতিটি মানুষ রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে তাঁর কর্তব্য পালন করবেন, তাঁর ধর্ম এখানে কোনো বিষয় নয়। রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দেওয়া যাবে না, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার করা যাবে না, এই দুটি বাক্যকে তো এভাবেও বলা যেতে পারে যে নিজের ব্যক্তিস্বার্থ বা গোষ্ঠীস্বার্থ উদ্ধার করার জন্য তার সম্প্রদায়ের মানুষদের উসকে দিয়ে অন্য ধর্মের মানুষের জীবনে ক্ষতি ডেকে আনা কিংবা সাধারণ ধর্মকে ব্যবহার করে মানুষকে অসহিষ্ণু ও উত্তেজিত করে তোলা যাবে না। অন্য ধর্মের ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন বা তাঁকে নিপীড়ন করা যাবে না।

এই সরল কথাগুলোই জানিয়ে দিচ্ছে, আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন গোষ্ঠীর দ্বারা সংবিধানের এই প্রতিটি অংশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যাগুরুরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন চালায়, এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর সবখানেই তা ঘটে। পৃথিবীর সবখানে ঘটে বলে প্রসঙ্গটি এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমাদের দেশে একটা মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, দেশের মানুষ ধর্মের নামে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অনৈতিকতা ও শাসন-শোষণকে লাল কার্ড দেখিয়েছিল। তার মানে, ১৯৭১ সালে এসে যে মুক্তিযুদ্ধ হলো, সেটি ছিল ধর্মের নামে, জাতির নামে যেকোনো ধরনের শোষণের বিরোধী, অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার আকাঙ্ক্ষা। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলা হবে, অথচ সেই চেতনার কবর দেওয়া হবে, এটা কোনো চিন্তাশীল জাতির পরিচয় নয়।

চার.
এবার এই টিপবিদ্বেষী লোকটির মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করি। আমরা চাই বা না চাই, নানা কারণেই আমাদের এখনকার বাংলাদেশের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নের বাংলাদেশের মধ্যে অনেক বড় ফারাক তৈরি হয়েছে। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে রেমিট্যান্সের সঙ্গে সঙ্গে সালাফি মতবাদ প্রবেশ করেছে, গ্রামে গ্রামে আধুনিক বোধবুদ্ধিওয়ালা মানুষের হাত থেকে সামাজিক নেতৃত্ব চলে গেছে গোঁড়া রক্ষণশীল মানুষের হাতে। সবখানেই তাঁদের দেওয়া ফতোয়ায় বিশ্বাসী হয়ে উঠছে মানুষ। আর তাতে বিতর্ক করার কোনো জায়গা খোলা থাকছে না। গোঁড়ামি দিয়েই চলছে সমাজ। যার প্রত্যক্ষ ফল আমরা দেখতে পাই যত্রতত্র।

এখন হাট-বাজারে কোনো সিনেমার গান অথবা লোকজ সংগীত অথবা ব্যান্ডসংগীত বাজতে শোনা যায় না। সেখানে চলে শুধু কতিপয় কিছু লোকের ওয়াজ। ধর্মের নামে চলা এসব ওয়াজ কিছুক্ষণ শুনলে বোঝা যায়, সেখানে নারীর পোশাক-আশাক নিয়ে অকথ্য ভাষায় বয়ান দেওয়া হচ্ছে। যে রসাল ভাষায় নারীদেহের বর্ণনা দেওয়া হয়, তা শোনার জন্য অবদমিত শরীর ও মন উৎসুক হয়ে উঠলে কাউকে দোষ দেওয়া যাবে? বিশ্বাস না হলে একবার কান খাড়া করে শুনুন। চমকে যাবেন। এসব বক্তৃতায় দেওয়া হয় আরও নানা ধরনের উসকানি। এজন্য বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থাও নিয়েছে।

গ্রামবাংলার যাত্রা-পালাগানকে বর্বররা বিতর্কিত করেছে ‘প্রিন্সেস লাকি খান’দের অশ্লীল নৃত্য যুক্ত করে। অথচ যাত্রা, পালাগান, জারি, সারি, আলকাপ ছিল গ্রাম্য সমাজের বিনোদনের সূক্ষ্ম মাধ্যম। কিন্তু সেগুলোও প্রায় বিদায় নিয়েছে। দেশ থেকে বাংলার চিরায়ত সাংস্কৃতিক আবহকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হয়েছে। এ তো গেল একটি দিক। পুরো সাংস্কৃতিক জীবনেই একটা রক্ষণশীল সৃজনহীনতা রাজত্ব করছে। কেউ কি তা অনুভব করতে পারছে না?

আর সেই রক্ষণশীল, চরম সৃজনহীনতার শিকার হয়েছেন সেই নারী শিক্ষক। কে কোন পোশাক পরে রাস্তায় বের হবে, কিছুদিন পর যদি তা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এ রকম গোঁড়া রক্ষণশীলদের রাস্তায় রাস্তায় দেখা যায়, তাহলে তার দায়ভার কে নেবে?

আমাদের রাজনীতিকেরা যখন আখের গোছাতে ব্যস্ত, সংস্কৃতিসেবী ও বুদ্ধিজীবীরা সরকারের মুখাপেক্ষী, সাংবাদিকেরা যখন দেশ ও দশের কথা না বলে অন্য কথা নিয়ে ব্যস্ত, তখন কোন মাকড়সা কোথায় তার জাল বুনছে, সেটা বুঝে ওঠা কি খুব কঠিন ব্যাপার? একই প্রশ্ন রাখা যায় যেকোনো পেশাজীবীর ক্ষেত্রে। সবকিছু, এমনকি মুক্তিযুদ্ধের অর্জনকেও যদি জাতিগতভাবে জীবন থেকে বিদায় করে দেওয়ার মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে পুলিশের পোশাকে ধর্মান্ধতার চাষ হবে না তো কী হবে?

যদি এই গোঁড়ামির টুঁটি চেপে ধরা না হয়, তাহলে সামনে কী ভয়াবহ সময় অপেক্ষা করছে—সেটা নিশ্চয়ই বুঝিয়ে বলতে হবে না।

জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ