হোম > ছাপা সংস্করণ

সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক দলিল

ড. মো. শাহজাহান কবীর

ইসলাম সম্প্রীতি ও মানবতার ধর্ম। শান্তি-সৌহার্দ্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় ইসলামের রয়েছে শাশ্বত আদর্শ ও সুমহান ঐতিহ্য। ইসলাম সব মানুষের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে বিশ্বাসী। সর্বকালের শ্রেষ্ঠ মানব মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও পরকালে মুক্তির জন্য জীবনভর সংগ্রাম করে গেছেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়-ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সবার মধ্যে ভ্রাতৃত্বসুলভ মনোভাব জাগ্রত করেছেন। ৬২২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর মহানবী (সা.) আল্লাহ তাআলার নির্দেশে মদিনায় হিজরত করেন। সেখানে বসবাসরত আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে ছিল দীর্ঘদিনের গোষ্ঠীগত হিংসা-বিদ্বেষ। বিবাদে জড়িয়ে থাকা এ দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপন করা এবং মদিনায় বসবাসরত সব গোত্রের মধ্যে সুশাসন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি একটি সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা ইতিহাসে ‘মদিনা সনদ’ নামে পরিচিত। এটিই পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম লিখিত সংবিধান।

মদিনা সনদের উল্লেখযোগ্য ধারা
মদিনা সনদে মোট ৬১টি ধারা ও উপধারা ছিল। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ধারা এখানে তুলে ধরা হলো:

  • সনদে স্বাক্ষরকারী গোত্রগুলো ইসলামি রাষ্ট্রের অধীনে একটি সাধারণ জাতি
    গঠন করবে।
  • হজরত মুহাম্মদ (সা.) ইসলামি রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান থাকবেন।
  • কোনো গোত্র গোপনে কুরাইশদের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তি করতে পারবে না। মদিনা বা মদিনাবাসীর বিরুদ্ধে কুরাইশদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে পারবে না।
  • মুসলিম, খ্রিষ্টান, ইহুদি, পৌত্তলিক ও অন্যান্য সম্প্রদায় ধর্মীয় ব্যাপারে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করবে। কেউ কারও ধর্মীয় কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
  • মদিনায় যেকোনো বহিরাক্রমণ রাষ্ট্রের জন্য বিপদ বলে গণ্য করতে হবে এবং সেই আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য সব সম্প্রদায়কে এক জোট হয়ে অগ্রসর হতে হবে।
  • রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার ও নিরাপত্তা রক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
  • অসহায় ও দুর্বলকে সব সময় সাহায্য ও রক্ষা করতে হবে।
  • সব ধরনের রক্তক্ষয়, হত্যা ও বলাৎকার নিষিদ্ধ করতে হবে এবং মদিনাকে পবিত্র নগরী বলে ঘোষণা করা হবে।
  • একটি সম্প্রদায়ের কোনো সদস্য ব্যক্তিগত অপরাধ করলে তা ব্যক্তিগত অপরাধ হিসেবেই বিবেচিত হবে। তার জন্য পুরো সম্প্রদায়কে দায়ী করা যাবে না।
  • মুসলমান, ইহুদি ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা পরস্পর বন্ধুসুলভ আচরণ করবে।
  • রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিরোধ নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে রাষ্ট্রপ্রধানের এবং তিনি হবেন প্রধান বিচারপতি।
  • মহানবী (সা.)-এর অনুমতি ছাড়া মদিনাবাসী কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারবে না।
  • মুসলমানদের কেউ যদি অন্যায় কিংবা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তবে সবাই মিলে তার বিরুদ্ধে যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। নিজ সন্তান বা আত্মীয় হলেও এ ব্যাপারে তাকে ক্ষমা করা যাবে না।

মদিনা সনদ থেকে যা শেখার আছে
মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর ওপর মদিনার শাসনতান্ত্রিক কর্তৃত্ব অর্পিত হয়। কুরাইশদের বিরুদ্ধে ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে এটি তাঁর ক্ষমতা ও মর্যাদা বাড়িয়ে দেয়। মদিনা সনদ মদিনার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও নাগরিক জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনে। প্রথমত, এই সনদ মদিনায় রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দ্বিতীয়ত, আল্লাহর রাসুলের দেওয়া নতুন সংবিধান অনুযায়ী এটি গৃহযুদ্ধ ও অনৈক্যের স্থলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে। তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মদিনার সব নাগরিককে এই সনদ সমান অধিকার দেয়। চতুর্থত, এটি মদিনার মুসলমান ও অমুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি গড়ে তোলে এবং মুহাজিরদের মদিনায় বসবাস ও জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থা করে। পঞ্চমত, মদিনায় ইসলামের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, যা নিয়মতান্ত্রিক ইসলামি প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে।

মদিনা সনদ মহানবী (সা.)-এর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, কূটনৈতিক দূরদর্শিতা ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় বহন করে। তার প্রণীত এ সনদে বহুজাতিক রাষ্ট্রের ধারণা, মানবাধিকার সুরক্ষা, আইনের শাসন, ধর্মীয় স্বাধীনতা, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও সহাবস্থানের বার্তা পাওয়া যায়। এই সনদ উদারতার ভিত্তিতে বৃহত্তর জাতি গঠনের পথ উন্মুক্ত করে, যা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

মদিনা সনদ গোষ্ঠীগত চুক্তি হয়েও সর্বজনীনতা লাভ করেছে। এই চুক্তি উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, গোত্রীয় দম্ভ, ধর্মবিদ্বেষ, অঞ্চলপ্রীতিসহ মানবতার অন্তরায় সব ধরনের প্রয়াস বন্ধ করে দেয় এবং নাগরিকদের ন্যায্য অধিকার সংরক্ষণ ও তাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের বিবরণ দেয়। এই দলিল পর্যালোচনা করলে মহানবী (সা.)-এর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ইসলামে মানবাধিকার-সংক্রান্ত পাঁচটি প্রধান ধারা নির্ধারণ করা হয়েছে। তা হলো—জীবন, সম্পদ, বংশ, জ্ঞান ও ধর্ম রক্ষা। মূলত আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দেওয়া বিধানের আলোকে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। যার প্রমাণ মদিনা সনদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উল্লেখ রয়েছে।

মদিনা সনদ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা হিংসা-বিদ্বেষ, নৈরাজ্য, সংঘাত ও যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ করে যুদ্ধবাজ গোত্রগুলোর মধ্যে গড়ে তোলে সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার বন্ধন।

তাতে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার সমান অধিকার নিশ্চিত হয়। মদিনায় বসবাসরত সব জাতি-গোত্র এ আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে মদিনায় একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়। মদিনা সনদ সবার কাছে দারুণ গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এ সনদ সম্প্রীতি, সহাবস্থান ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার আদর্শ পথনির্দেশ।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ফারইস্ট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ