যশোরে জন্ম প্রমথ চৌধুরীর। ছেলেবেলায় সেখান থেকে কৃষ্ণনগরে চলে আসেন। কৃষ্ণনগরে এসে প্রথমে তিনি আর বড় ভাই কুমুদনাথ ভর্তি হয়েছিলেন মিশনারি স্কুলে। বড় স্কুল। সপ্তাহে একজন পাদরি এসে খ্রিষ্টধর্ম সম্পর্কে বাংলায় বক্তৃতা করতেন। মাসখানেক পর প্রমথ চৌধুরীর বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্কুলে কী শিখছ?’
তাঁরা দুই ভাই বললেন, ‘আদম আর ইভের নাম জেনেছি।’
এ কথা শুনে বাবা খেপে গেলেন। তখন তাঁরা বললেন, ‘পাদরি সাহেবের কাছে আমরা ভজন শিখেছি।’
বাবা বললেন, ‘কী ভজন?’
দুই ভাই গাইলেন,
‘বন্যে এল ভেসে গেল, চাষার ডুবল ধান,
শালাদের যেমন কর্ম তেমনি শাস্তি দিলেন ভগবান।’
এ ভজন শুনে চোখ রাঙিয়ে বাবা বললেন, ‘তোমাদের আর স্কুলে যেতে হবে না।’ তারপর তিনি প্রমথ চৌধুরীর মায়ের কাছে জানতে চাইলেন, ‘কী কর্ম?’
মা বললেন, ‘চাষাদের কুকর্ম এই যে তারা খ্রিষ্টান হয়নি।’
এরপর আর সে স্কুলে থাকা চলে না।
দুই ভাই ভর্তি হলেন ব্রজবাবুর স্কুলে। এই স্কুলটা ভালো লাগেনি প্রমথের। ছোট ক্লাসরুমকে মনে হতো অন্ধকূপ। সে স্কুলে কী পড়ানো হতো, সেটা বিস্মৃত হয়েছেন প্রমথ। শুধু মনে আছে শনিবারে প্রকাণ্ড পুরোনো ছবির বই থেকে বাঘ, ভালুক ইত্যাদির ছবি দেখানো হতো।
একদিন বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী পড়ছ?’
প্রমথ বললেন, ‘জানোয়ারের ছবি দেখছি।’
বাবা বললেন, ‘আমি স্কুল ভেবে তোমাদের দেখছি চিড়িয়াখানায় পাঠিয়েছি!’ পরদিন থেকেই এই স্কুল বাদ।
এরপর তাঁকে ভর্তি করানো হলো বালিকা বিদ্যালয়ে। তাতে খেলার মাঠের বালকেরা তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে বলত, ‘যাদের দশ হাত কাপড়েও কাছা নেই, তাদের সঙ্গে পড়া লজ্জার কথা!’
প্রমথ এসে বাবাকে বললেন, ‘যাদের দশ হাত কাপড়ে কাছা নেই, তাদের সঙ্গে এক স্কুলে পড়ব না।’
বাবা কথাটা শুনে প্রথমে হাসলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার কথা ঠিক!’
সূত্র: প্রমথ চৌধুরী, আত্মকথা, পৃষ্ঠা ১৭-১৮