মানুষের অর্থনৈতিক জীবনটা পাঠককে খুব সহজ করে বুঝিয়েছেন আকবর আলি খান। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি জানতেন, কী বলতে হবে। অযথা কাউকে খুশি করার জন্য তিনি কথা বলেননি। যখন প্রয়োজন মনে করেছেন, তখন সত্যটাই বলেছেন।
অন্য অনেকের মতোই তাঁকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ার আগে চিনতাম না। কিন্তু সে সময় আরও কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে ওই পদ থেকে পদত্যাগ করার আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিল, তিনি অন্য রকম একজন মানুষ। এই যুগে এ রকম মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এর পর থেকেই তাঁর লেখালেখির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। অর্থনীতি নিয়ে লেখা তাঁর বইগুলোর পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে লেখা তাঁর বই আগ্রহ নিয়েই পড়েছি। বঙ্গদেশে মুসলমানের আবির্ভাব বিষয়ে তাঁর গবেষণা পড়েছি, তা নিয়ে হওয়া আলোচনাগুলোর দিকেও আগ্রহভরে নজর রাখছি।
৮ সেপ্টেম্বর রাতে তাঁর মৃত্যুর পর ফেসবুকে বহু মানুষই তাঁকে নিয়ে লিখেছেন। ফেসবুকের বঙ্গীয় সংস্করণ অনুযায়ী এর মধ্যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক মন্তব্য ছিল। কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধকালে তাঁর ভূমিকার ব্যাপারে কিছু না জেনেই তাঁর প্রতি কটাক্ষ করেছেন। কেউ কেউ তাঁর বিভিন্ন সময়ে বলা বিভিন্ন কথাকে উদ্ধৃত করে বোঝাতে চেয়েছেন, তাঁর সব ভাবনাই মেনে নেওয়ার মতো ছিল না।
সেটা হতেই পারে। তিনি যা বিশ্বাস করেন, সেটা বলেছেন। যদি তাঁর বিশ্বাস পরবর্তীকালে সত্যে পরিণত না হয়, তাহলে তাঁকে খলনায়ক বানানোর কিছু নেই। এ যুগে আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে নিজের কথা বলার মানুষ আছে কজন? বিভিন্নভাবেই তো নানা লোভ আর দলবাজির ফেরে পড়ে গেছে দেশের সুধীজনদের বড় একটা অংশ। সেখানে নিজের মত স্থিরভাবে প্রকাশ করার মতো মানুষ হয়েই জীবন কাটিয়ে গেছেন আকবর আলি খান।
একজন গুণমুগ্ধ পাঠক তাঁর কিছু পর্যবেক্ষণের দিকে অন্য পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাবে—এ লেখার সেটাই একমাত্র উদ্দেশ্য। আকবর আলি খানের লেখায় আমরা লক্ষ করব আমাদের সমাজের ক্লেদ, লোভ, ছোটলোকি। দেখার চেষ্টা করব, দরিদ্র এবং বড়লোকের মধ্যে আদতে গরিব কারা।
আমাদের সমাজের বহুল পরিচিত ঘটনাগুলোই রসিকতার ভিয়েনে বর্ণনা করেছেন আকবর আলি খান। আমাদের দেশে দান-খয়রাত কিংবা ত্রাণ সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সদিচ্ছার অভাব নেই। সরকারি হোক, বেসরকারি হোক, উদ্যোগগুলোর উদ্দেশ্যই থাকে, গরিব মানুষ, উপায়হীন মানুষের হাতে যেন তা পৌঁছে যায়। কিন্তু আদতে আমরা দেখছি কী? স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সাহায্যদানের জন্য নিজেরা যে তালিকা করেন, তাতে নিজেদের আত্মীয়-স্বজন অথবা অবস্থাপন্ন ক্যাডারদের জায়গা করে দেন। যে ছিন্নমূল বা একেবারে দরিদ্র মানুষটি ত্রাণ বা দান-খয়রাত পাওয়ার যোগ্য, তিনি হয়তো জানতেই পারেন না, তাঁরই এটা প্রাপ্য। তিনি জানার আগেই তাঁর প্রাপ্য লোপাট করে কোনো অবস্থাপন্ন মানুষ।
এ রকম অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য দুটো কার্যকরী ব্যবস্থা আছে। একটা হলো, প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে যাঁরা ত্রাণসামগ্রী পাওয়ার অনুপযুক্ত, তাঁদের চিহ্নিত করা এবং তাঁরা যেন ত্রাণ না পান, সেদিকে কড়া নজর রাখা।
খুব ভালো হতো, যদি কাজটা এত সহজ হতো। এভাবে দুর্বৃত্তদের চিহ্নিত করা গেলে সত্যিকারের দরিদ্র মানুষটিই ত্রাণ বা দান-খয়রাত পেতে পারতেন। আকবর আলি খান যদি এই সমাধান দিয়ে থেমে যেতেন, তাহলে আমরা বলতে পারতাম, বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিয়ে তো আরও অনেক কথা আছে। আমাদের দেশে তো গভর্নমেন্ট সারভেন্ট নেই, বয়েই গেছে তাঁদের জনগণের চাকর হতে। তাঁরা নিজেদের মনে করেন জনগণের মালিক, জনতার মাথার ওপর চরকি ঘোরানোই তাঁদের কাজ। এই মানসিকতার কর্মকর্তা বা গ্রামের মাতব্বর কেন দরিদ্র মানুষের জন্য দরদ দেখাবেন? আমাদের প্রশাসনিক পদগুলোর একটা অংশ তো ‘উপরি’কে নিজেদের অধিকার বলে মনে করে। আকবর আলি খানকে এই প্রশ্নগুলো করে তাঁকে বিব্রত করা যেত। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ রাখেননি। দেখা গেল, তিনি ঘাগু লোক। প্রশাসন ও স্থানীয় মাতব্বরদের মধ্যে একটা মিলমিশ হয়ে গেলেই যে সর্বনাশ হয়ে যাবে, সেটা আকবর আলি খানের অজানা নয়। আমাদের দেশে বেতনভোগী সরকারি কর্মচারীরাও যে কম দুর্নীতিগ্রস্ত নন, সে কথাও তিনি জানিয়ে দেন আমাদের।
তাই এই মহা চুরি তাত্ত্বিকভাবে ঠেকানো গেলেও বাস্তবে দেখা যায়, যেই লাউ সেই কদু। তিনি লক্ষ করেছেন, খয়রাতি মাল বড়লোকেরা গায়েব করে দেয়; অর্থাৎ যে ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হচ্ছে, তা যদি লোভনীয় হয়, তাহলে সরকারি কর্মকর্তা বা গ্রামের মাতব্বরের পক্ষে মহানুভব হওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। গরিবের প্রাপ্য শোভা পায় তাঁদের নিজেদের কিংবা স্বজনের ঘরে। এ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? তাহলে ঠিক করতে হবে এমন কিছু, যা গরিবেরাই পাবে, যাতে বড়লোকদের আগ্রহ থাকবে না।
কোন জিনিসে উপকার হয় গরিবের? অর্থনীতি বলছে, পণ্য আছে তিন ধরনের। একটি হচ্ছে বিলাসদ্রব্য, একটি স্বাভাবিক পণ্য আর একটি নিকৃষ্ট পণ্য। সরল চোখেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, প্রথম যে বিলাসদ্রব্যের কথা বলা হয়েছে, সেটার ওপর একচেটিয়া অধিকার সমাজের অধিপতিদের। গরিবের পক্ষে সেখানে নাক ডোবানোর কোনো সুযোগ নেই। সাধারণ মানুষ যে পণ্য বা দ্রব্য কিনতে পারে, সেটাই স্বাভাবিক পণ্য। আকবর আলি খান বলছেন, লোকের আয় বাড়লে যে পণ্যের চাহিদা বাড়ে, সেটাই স্বাভাবিক পণ্য। আর লোকের আয় বাড়লে যে পণ্যের চাহিদা কমে, সেটা হলো নিকৃষ্ট পণ্য। আপনাদের শুনতে খারাপ লাগবে, তবু সত্য হলো, এই নিকৃষ্ট পণ্য যদি ত্রাণ হিসেবে কিংবা দান-খয়রাত হিসেবে দেওয়া হয়, তাহলে বড়লোক বা সরকারি কর্মকর্তারা সেটা আত্মসাৎ করবেন না।
ধরুন, বাংলাদেশের কোনো এক জায়গায় বন্যা হওয়ায় পরার মতো পোশাক পাঠাল উন্নত কোনো দেশ। পাঠাল নাইকি বা অ্যাডিডাসের জুতা কিংবা ট্র্যাকসুট। তারা তো আর জানে না, আমাদের দেশের গরিব মানুষ কোন ধরনের পোশাক পেলে খুশি হয়। এবার কথা হলো, নাইকি বা অ্যাডিডাস কি গরিব মানুষটার কাছে পৌঁছাবে? না, পৌঁছাবে না। এই বিলাসদ্রব্য তার হাতের নাগালের মধ্যে পৌঁছানোর আগেই গায়েব হয়ে যাবে। স্বাভাবিক পণ্য চাল দেওয়া হলেও সেই চাল পৌঁছাবে না গরিবের ঘরে, কারণ চালের প্রতি লোভ আছে বড়লোক মাতব্বর বা সরকারি কর্মকর্তার। তাহলে গরিব মানুষের হাতে পৌঁছাবে, এটা নিশ্চিত করতে হলে নির্ভর করতে হবে নিকৃষ্ট পণ্যের ওপর। গম দেওয়া হলে বড়লোকেরা সেটা চুরি করতে অনীহা দেখাবে। সে ক্ষেত্রে গরিবের হাতে সেই সাহায্য পৌঁছাতে পারে।
ঘুষ বা দুর্নীতির ব্যাপারে আকবর আলি খানের লেখায় যে রসিকতা আছে, তা শুধু সুখপাঠ্য নয়, শিক্ষণীয়ও। অনেকেই মনে করে থাকেন, ঘুষের রোগটা এসেছে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে। কিন্তু আকবর আলি খান আমাদের নিয়ে যাচ্ছেন ইতিহাসের আরও অনেক অনেক গভীরে। এই অঞ্চলে ঘুষ খাওয়ার প্রচলন যে নিতান্ত শিশু নয়; বরং এর সঙ্গে অভ্যস্ততা হাজার বছরের, সে কথা তিনি তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বলেছেন। অন্যান্য দেশে দুর্নীতিও বহু আগে জন্মেছে, সেটাও বলেছেন।
আজকের আলোচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটা এখন বলব তাঁরই রচনার রেশ ধরে। দুর্নীতির মতো জটিল সমস্যার কথা বলতে গিয়ে তিনি বহু আগেই সরাসরি বলেছেন, দুর্নীতি নিয়ে খুব বেশি আলোচনা হয় না এই কারণে যে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে দুর্নীতির কোনো বৈরিতা নেই; অর্থাৎ উন্নয়নও হবে, টাকাপয়সা মেরে-কেটে খাওয়াও যাবে। আমাদের নিকট অতীত কিংবা বর্তমানেও কি এ কথাটির সত্যতা খুঁজে পাওয়া কঠিন? বিভিন্ন বড় বড় প্রকল্প হাতে নেওয়ার সঙ্গে কি দুর্নীতির সম্পর্ক একেবারে কম?
অর্থনীতির আরও অনেক গলি আর রাজপথ ঘুরেছেন আকবর আলি খান। আমরা চেষ্টা করলাম, তাঁর উজ্জ্বলতার কিছুটা বিচ্ছুরণ ঘটাতে। ত্রাণ, দান-খয়রাতের বিষয়টি পরিষ্কার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘুষ, দুর্নীতি নিয়েও তাঁর পর্যবেক্ষণ দেখে বিস্মিত হই। তাঁর লেখালেখির আরেকটু গভীরে গেলে দেখতে পাওয়া যাবে, দুর্নীতি কেন হয়, তা নিয়ে ছড়িয়ে থাকা মতবাদগুলোও তিনি বর্ণনা করেছেন রসিকতার সঙ্গে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাড়িয়ে দুর্নীতি থেকে দূরে রাখা যায় কি না, সেই প্রশ্ন নিয়েও নাড়াচাড়া করেছেন তিনি। আমরা আমাদের দেশের অভিজ্ঞতায় কী দেখতে পাই, সেটা বলে বোঝানোর দরকার নেই। ভুক্তভোগী সবাই তা জানে।
‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’। সেই সহজ কথা সহজে বলার চেষ্টা করেছেন আকবর আলি খান। তাঁর প্রয়াণ আমাদের দেশের জন্য কত বড় ক্ষতি—আমরা এখনো হয়তো সম্যক উপলব্ধি করতে পারছি না।
লেখক: উপসম্পাদক আজকের পত্রিকা