ভুল রাস্তায় বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। ফোন পেয়ে আবার ঠিকানামতো ফিরে আসা। নারায়ণগঞ্জ খুব বড় শহর না হলেও হাতে গুনে দুবার গিয়েছিলাম বলে এই বিপত্তি। ঠিকানামতো এসে দেখা হলো ছিপছিপে গড়নের লম্বা-চওড়া মানুষটির সঙ্গে। হাত মিলিয়ে বললেন, ‘চলুন। বোস কেবিনে চা খেয়ে আসি।’ তারপর রিকশা ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রসিদ্ধ বোস কেবিনে চলে গেলাম। সেখানে ডিম ভাজা, পরোটা আর চা খেয়ে হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো নারায়ণগঞ্জ ঘুরে বঙ্গবন্ধু সড়কের বাড়িটায় ঢুকে গেলাম আমরা। তারপর লিফটে চরে উঠে গেলাম তাঁর অফিস রুমে। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেশ খানিকটা ধাক্কা খেলাম—বিস্ময়ে।
দরজা খুলেই যে লম্বা করিডর, তার দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা বেশ কিছু চিত্রকর্ম, একেবারে মাস্টারপিস। দেখে ভ্রম হয়, কোনো প্রদর্শনী নয় তো? যাঁদের চিত্রকর্ম বিষয়ে খানিক আগ্রহ আছে তাঁরা জানেন, কামরুল হাসান, হাশেম খান, কাইয়ুম চৌধুরী, কালিদাস কর্মকার, অলকেশ ঘোষ, শিশির ভট্টাচার্য্য, আব্দুস শাকুর, ফরিদা জামান, রণজিৎ দাস, হামিদুজ্জামান, রোকেয়া সুলতানাসহ আরও অনেকের ছবি একসঙ্গে দেখাটা একটা ঘটনা বটে। কিন্তু আমি মূলত দেখতে এসেছি একেবারে অন্য জিনিস। ফলে দেশের চিত্রশিল্প জগতের এই মহারথীদের আঁকা ছবি দেখতে পাওয়া একধরনের উপরি পাওনা। আর উপরি পাওনা পেলে কে না খুশি হয়।
যাঁর কথা বলছি, তাঁর নাম মুনতাসীর মঈন। উনিশ শ চল্লিশের দশকে তাঁর দাদা চুয়াডাঙ্গা থেকে নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন পাটের ব্যবসা করতে। সেই শুরু। তারপর তিন প্রজন্ম থিতু হয়েছেন এ শহরে। মুনতাসীর মঈনের বাবা মোসাদ্দেক মঈন করেছেন গার্মেন্টসের ব্যবসা, নব্বইয়ের দশকজুড়ে। আর তিনি করেন বায়িং হাউসের ব্যবসা। জাপানের বায়ারদের জন্য তিনি তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের পোশাক। ব্যবসার পাশাপাশি মুনতাসীর মঈন নিয়মিত ছবি আঁকেন প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে। একজন ব্যস্ত ব্যবসায়ী কেন ৩৫-৩৬ বছর ধরে প্রতিকৃতি বা পোর্ট্রেট এঁকে চলেছেন, সেটা জানার আগ্রহ ছিল আমার। সে জন্যই এক ছুটির দিন উপস্থিত হয়ে যাই নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের মঈন টাওয়ারে তাঁর অফিসে।
মুনতাসীর মঈন মূলত প্রতিকৃতি আঁকেন। একটি প্রতিকৃতি আঁকতে তাঁর সময় লাগে এক থেকে দুই মিনিট! এটিই তাঁর বিশেষত্ব। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না করেও বিষয়টি কীভাবে সম্ভব হচ্ছে, যখন তিনি এমবিএ পড়েছেন ব্যবসা করার জন্য? মুনতাসীর সহজ করে দিলেন। বললেন, ‘বারো বছর একটানা কোনো কাজ করতে পারলে মানুষ তাতে মাস্টার হয়ে যায়। আমি তো করছি ৩৫ বছর ধরে।’ বিষয়টি এখানেই সীমাবদ্ধ কি? মুনতাসীর জানান, তিনি শত ব্যস্ততার মাঝেও প্রতিদিন অন্তত পাঁচ মিনিট ছবি আঁকার পেছনে ব্যয় করেন। ‘প্রতিদিন পাঁচ মিনিট’ চর্চার বিষয়টিই তাঁকে প্রতিকৃতি আঁকায় দক্ষ করে তুলেছে। বন্ধুদের জন্মদিনে উপহার হিসেবে কিংবা পরিবারের মানুষদের জন্য তিনি প্রতিকৃতি আঁকেন ভালোবেসে। বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতিও এঁকেছেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের ‘ডাইহার্ট ফ্যান’ বলে তাঁর গল্পে নিজেকে কল্পনা করে এঁকেছেন নিজের ছোটবেলা। সত্যজিতের প্রতিকৃতি এঁকেছেন, এঁকেছেন উৎপল দত্ত ও উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, সংগীতশিল্পী নুসরত ফতে আলীর পোর্ট্রেটও। অনেক লাইন ড্রয়িং করেছেন ইতিমধ্যে এবং নিয়মিত করে চলেছেন।
মুনতাসীর মঈন শুধু একজন ‘আর্ট লাভার’ নন। নিজে যেমন ছবি আঁকেন, তেমনি খোঁজখবর রাখেন দেশের তরুণ শিল্পীদের। তরুণ শিল্পীদের চিত্রকর্মের বেশ সমৃদ্ধ সংগ্রহ রয়েছে তাঁর। তিনি মনে করেন, যেকোনো ‘অবজেক্ট’-এর চেয়ে শিল্পকর্ম অনেক বেশি মূল্যবান। এ জন্য সামর্থ্য থাকলে সবারই শিল্পকর্ম সংগ্রহ করা উচিত। কারণ দিন যত যেতে থাকে, ততই এর মূল্য বাড়তে থাকে বিভিন্নভাবে। তবে এ জন্য চিন্তায় ও মননে ভালো শিল্পীদের খুঁজে তাঁদের ছবি কেনার প্রতি জোর দেন তিনি।
শুধু ছবি আঁকা নয়। এলপিজি রেকর্ড কিংবা পুরোনো বই সংগ্রহ এবং ভ্রমণ করতেও ভালোবাসেন মুনতাসীর। একটি ভ্রমণবিষয়ক লেখার সূত্রেই তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল কিছুদিন আগে। লেখা বিষয়ে মুগ্ধতার কথা জানিয়েছিলাম তাঁকে। অনুরোধ করেছিলাম, আরও লেখার।
ব্যবসা, ভ্রমণ ও ছবি আঁকা—এ নিয়েই মুনতাসীর মঈন, একজন ছবির মানুষ।