আজ থেকে ঠিক ১৪ বছর আগে কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় ১১টি জেলা। সিডর নামের সেই ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হেনেছিল বাগেরহাটের শরণখোলার বলেশ্বর নদ দিয়ে। তারই পার্শ্ববর্তী উপজেলা মোংলার চিলা গ্রাম।
সেই দিন বিকেলে শত শত মানুষের সঙ্গে জীবন বাঁচাতে স্থানীয় সেন্ট মেরিস গির্জা সংলগ্ন আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছিলেন অন্তঃসত্ত্বা সাথী সরকার ও তার স্বামী জর্জি সরকার। তীব্র প্রসব বেদনার মধ্যেও অনাগত সন্তানের জীবন বাঁচাতে এখানে ছুটে এসেছিলেন এই মা। সূর্যোদয়ের আগে তার কোল জুড়ে আসে ফুটফুটে এক শিশু।
ঘূর্ণিঝড়ের ধ্বংসলীলার মধ্যে নতুন প্রাণের বারতা বয়ে আনলো যে শিশুটি সাথী দম্পতি তার নাম রাখলেন সিডর । সিডর সরকার। উপকূলীয় এলাকার মানুষের সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠল সিডর। ঘূর্ণিঝড়ের ১৪ বছর পূর্তির সঙ্গে সিডরও চৌদ্দতে পা দিল।
আর এ ১৪ বছর ধরে চলছে সিডরের পরিবারের টিকে থাকার যুদ্ধ। প্রকৃতির রুদ্ররোষ মাথায় নিয়ে যে শিশু পৃথিবীতে এসেছিল সে কি করে যুদ্ধ ছাড়া চলবে?
উপকূলীয় আর দশটি পরিবারের মতো নিদারুণ অভাব পিছু ছাড়েনি সিডরের পরিবারের। রবিবার সকালে সিডরের বাবা জর্জি সরকারের একমাত্র অবলম্বন মাত্র তিন কাঠা জায়গার ওপরে যে টিনের ঘরটি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে গেলে সিডরের দাদী রিভা সরকার জানালেন, সিডরের বাবা জর্জি সাগরে গিয়েছেন মাছ ধরতে। এখন অন্যের কাছ থেকে নৌকা ধার করে সুন্দরবনের নদী-খালে মাছ,কাঁকড়া ধরতে যান তিনি। খেয়ে না খেয়েই চলছে তাদের জীবন।
সিডরের মা সাথী সরকার একমাত্র সন্তানকে ছেড়ে ঢাকায়। একটি বাসায় গৃহ পরিচারিকার কাজ করেন। সিডর এত দিন পাশের খুলনা জেলার দাকোপ উপজেলায় একটি বিদ্যালয়ে পড়ত। করোনার কারণে সে এখন মোংলায় বাড়িতে থাকে। এখন থেকে মোংলায় থেকেই এখানে স্কুলে পড়বে সে।
আজকের পত্রিকার সাংবাদিক এসেছে শুনে সিডর পাশের মাঠে খেলা ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়াল। প্রকৃতির মতোই দুরন্ত সে। ‘কেমন আছ’? একগাল হাসিতে উত্তর, ‘ভালো আছি’। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে? ‘ভালো। ভালো করে না পড়লে তো বাবার মতো জেলে হতে হবে’। হাসতে হাসতে উত্তর দিল সে। মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করে না? হাসিমুখটা হঠাৎই গম্ভীর হয়ে গেল। অভিমান ভরা উত্তর, মা-তো অনেক দূরে কাজ করে। আসতে তো পারে না।
উপকূলীয় মানুষের সংগ্রাম আর জীবনের প্রতীক সিডর বাবা-মায়ের আদর, ভালোবাসা ছাড়াই বেড়ে উঠছে। এই ১৪ বছর বয়সেই সে বুঝে গেছে, উপকূলের মানুষের প্রকৃতি আর দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয়। তাকেও হবে। প্রতি বছর ১৫ নভেম্বর এলে তাকে নিয়ে পত্রিকায় ছবি ছাপা হয়। টিভি চ্যানেলেও দেখানো হয়। কিন্তু তাঁর ভাগ্যের পরিবর্তনে কেউ এগিয়ে আসে না।