সন্তানকে নিয়ে মানুষের অনেক স্বপ্ন থাকে। সন্তান বড় হয়ে মানুষের মতো মানুষ হবে, মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে, বার্ধক্যে তাঁদের অবলম্বন হবে—এমন প্রত্যাশা থাকে প্রতিটি মানুষের। সেই প্রত্যাশা অনেক সময় পূরণ হয় না। বরং মা-বাবার আশা হতাশায় পর্যবসিত হয়। মানুষের ঘরে জন্ম নিলেই কি সবাই মানুষ হয়? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বই-পুস্তকের সাহায্যের দরকার পড়ে না। আমাদের চারপাশের নানা ঘটনার দিকে তাকালেই এর জবাব পাওয়া যাবে। আজকাল ফেসবুকে প্রচারিত একটি কথা প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে—‘অমানুষগুলো দেখতে ঠিক মানুষের মতো’। কথাটি উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। সমাজের কতিপয় মানুষ এমন সব ঘটনার জন্ম দেয় যে তাদের মানুষ বলতে দ্বিধা হয়। অনেক সময় বনের পশুর সঙ্গে তাদের পার্থক্য করা কষ্টকর হয়ে পড়ে।
সন্তান মানবজীবনের এক পরম আরাধ্য ধন। যে দম্পতির সন্তান নেই, তাদের জীবন অপূর্ণই থেকে যায়। কিন্তু সেই সন্তানই কখনো কখনো মা-বাবার জন্য মনঃকষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যে সন্তানকে মানুষ করার জন্য বাবা-মা তাঁদের জীবনের সব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করেন, অর্জিত সম্পদ ব্যয় করেন, যখন শোনা যায় সেই সন্তানই বৃদ্ধ বাবা-মাকে রাস্তায় ঠেলে ফেলে দিয়েছে, বিবেকবান মাত্রই চমকে ওঠেন। এমন খবর আজকাল পত্রিকার পাতায় মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত তেমনই একটি খবর আলোড়ন তুলেছে। পিতার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে ফেলে রেখে তাঁর সঞ্চিত অর্থের ভাগাভাগি নিয়ে সন্তানেরা মেতেছিল বিবাদে। এ কারণে হতভাগ্য পিতার লাশ দুই দিন ধরে পড়ে ছিল বাড়ির সামনে।
গত ২৭ ডিসেম্বর আজকের পত্রিকায় ‘অবশেষে মাটি পেলেন বাবা’ শিরোনামে খবরটি পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়েননি—এমন মানুষ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। ঘটনাটি চট্টগ্রামের। যে হতভাগ্য বাবা পত্রিকার শিরোনাম হয়েছেন, তাঁর নাম মনির আহমদ। কর্ণফুলী উপজেলার কেরানি বাপের বাড়ী এলাকায় তাঁর বাড়ি। ভদ্রলোক চাকরি করতেন পদ্মা অয়েল কোম্পানিতে। রেখে গেছেন স্ত্রী, দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। এক ছেলে প্রবাসী। অবসরে যাওয়ার পর কোম্পানি থেকে পাওয়া পেনশন ও অন্যান্য সুবিধার অর্থ জমা রেখেছিলেন ব্যাংকে; যার পরিমাণ ৫০ লাখ টাকা। গত ২৪ ডিসেম্বর মনির আহমদ একটি হাসপাতালে মারা যান। লাশবাহী ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সে তাঁর মরদেহ আনা হয় বাড়িতে। তার পরই ঘটে ওই ন্যক্কারজনক ঘটনা। পিতার লাশ অ্যাম্বুলেন্সে রেখেই ব্যাংকে গচ্ছিত টাকার ভাগাভাগি নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়েন সন্তানেরা। মরহুমের স্ত্রী ও এক ছেলে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, কাউকে না জানিয়ে থেরাপি দেওয়ার নাম করে এবি ব্যাংকের চৌমুহনী শাখায় মনির আহমদকে নিয়ে মেজ মেয়ে বেবি আক্তার ৩০ লাখ টাকা তুলে নেয়। যদিও বেবি আক্তার এ কথা অস্বীকার করেছেন। এ নিয়ে চলতে থাকে ঝগড়া। ঘটনাটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে, ভাইরাল হয় সামাজিক মাধ্যমেও।
স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের লোকেরা বাবার লাশ দাফনের জন্য সন্তানদের বারবার তাগাদা দেন। কিন্তু তাঁরা তাতে কর্ণপাত না করে টাকার জন্য কলহে লিপ্ত থাকেন। অবশেষে চেয়ারম্যান ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের হস্তক্ষেপে দুই দিন পর তাঁরা ঝগড়ায় বিরতি দিয়ে পিতার লাশ দাফনে সক্রিয় হন।
বেঁচে থাকতে মনির আহমদ কি ভাবতে পেরেছিলেন, ওয়ারিশ থাকা সত্ত্বেও তাঁর লাশ এভাবে দুই দিন বেওয়ারিশের মতো অ্যাম্বুলেন্সে পড়ে থাকবে? তিনি তাঁর সন্তানদের খাইয়ে-পরিয়ে বড় করেছেন, লেখাপড়া শিখিয়েছেন। মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তিনি তো সন্তানদের মুখাপেক্ষী ছিলেন না। জীবদ্দশায় তিনি হয়তো আশা করেছিলেন, সন্তানেরা বার্ধক্যে তাঁর অবলম্বন হবে, মৃত্যুর পর সযত্নে দাফন করে আল্লাহ তাআলার দরবারে তাঁর রুহের মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করবেন। কিন্তু কী দেখা গেল?
বাবার লাশ ফেলে রেখে সন্তানেরা ‘এক টুকরো মাংস’ নিয়ে কুকুরের কামড়াকামড়ির মতো বিবাদে মত্ত হলেন! এঁদের কি মানুষ বলা যায়? স্বার্থের কারণে যাঁরা জন্মদাতা বাবার প্রতি এমন অবহেলা-অশ্রদ্ধা করতে পারেন, অন্যদের বেলায় তাঁরা কী করবেন, ভাবাই যায় না। মৃত ব্যক্তিদের আত্মা পৃথিবীর মানুষ কিংবা তাদের কাজকর্ম দেখতে পারে কি না, আমরা জানি না। যদি দেখতে পায়, তাহলে সন্তানদের এই অমানুষের মতো আচরণ দেখে মনির আহমদের আত্মা নিশ্চয়ই হাহাকার করে উঠেছে! তাঁর আত্মা হয়তো বলছে, এ আমি কাদের রেখে এলাম দুনিয়ায়! এদের তো আমি মানুষ করতে পারিনি! এই হতাশায় পরপারেও হয়তো তিনি শান্তিতে থাকতে পারবেন না।
কতিপয় সন্তানের এমন নিষ্ঠুরতা আমাদের সমাজে বিরল নয়। মাঝেমধ্যেই এ ধরনের খবর আমরা পাই। এই তো বছরখানেক আগে নারায়ণগঞ্জের এক হতভাগ্য মাকে স্থানীয়রা আবিষ্কার করেছিল গোয়ালঘরে। পুত্র-কন্যারা তাকে বাসগৃহে ঠাঁই দেননি। গণমাধ্যমে খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর জেলা প্রশাসক স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন এবং তাঁর পুত্রকে ধরে এনে মাকে নিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলেন। আরেকজন দুর্ভাগা পিতার করুণ কাহিনি শুনেছিলাম; ঢাকার উত্তরায় যাঁর একটি ছয়তলা বাড়ি ছিল। কিন্তু ছেলেমেয়েরা তাঁকে সে বাড়িতে থাকতে দেননি। মসজিদের বারান্দায় অসুস্থ মানুষটির দিন কাটত। এক সহৃদয় ব্যক্তি তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তিনি যখন মারা গেলেন, তাঁর ছেলেরা খবর পেয়েও পিতাকে দাফন করতে আসেননি।
সব পিতা-মাতাই তাঁদের সন্তানকে মানুষ করতে চান। কিন্তু সবাই কি আক্ষরিক অর্থে মানুষ হয়? সম্ভবত না। আর সে জন্যই এই সমাজ-সংসারে প্রতিনিয়ত ঘটে নানা অঘটন। কোথাও পিতাকে খুন করছে পুত্র, ভাইয়ের বুকে ছোরা বসাচ্ছে ভাই। কোথাও আবার দুর্বৃত্তের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে আর্তনাদ করছে কোনো মজলুম। সমাজে যেসব সন্ত্রাসী-দুর্বৃত্ত বুক ফুলিয়ে চলছে, তারাও তো কোনো না কোনো পিতা-মাতার সন্তান। তারা কেন মানুষ হলো না? পৃথিবীতে এমন কোনো মা-বাবা নেই, যাঁরা চান না তাঁদের সন্তান মানুষের মতো মানুষ হোক। সব মা-বাবা তাঁদের সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করেন সন্তানকে মানুষ করতে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এদের কেউ কেউ মানুষ হয় না। এই না হওয়ার ব্যর্থতা কার বা কাদের, তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে বিজ্ঞজনেরা বলে থাকেন, নৈতিক শিক্ষার অভাবই সন্তানের বখে যাওয়ার কারণ; যা তাকে একসময় অমানুষে রূপান্তরিত করে।
মা-বাবার কঠোর নজরদারিতেই আমরা বেড়ে উঠেছি। সারা দিন কোথায় যাচ্ছি, কার সঙ্গে মিশছি, কী করছি, তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নিতেন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পর। একটু এদিক-সেদিক দেখলেই জারি হয়ে যেত সামরিক শাসন। এমনকি তাঁরা স্কুলে শিক্ষকদের কাছে চলে যেতেন, ছাত্র কেন মানুষ হচ্ছে না, তার কৈফিয়ত তলব করতে।
অভিভাবকদের অনুমোদন পেয়ে শিক্ষকেরাও শিক্ষার্থীদের মানুষ বানানোর চেষ্টা করতেন কঠোরতার সঙ্গে। আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, আমাদের বাংলা ব্যাকরণের শিক্ষক শ্রদ্ধেয় স্বর্গীয় প্রহ্লাদ চন্দ্র মণ্ডল একটি ভাবসম্প্রসারণ পড়িয়েছিলেন—‘তরুলতা সহজেই তরুলতা, পশুপাখি সহজেই পশুপাখি। কিন্তু মানুষ? অনেক সাধনার পরে মানুষ’।
অত্যন্ত চমৎকার করে তিনি সেদিন আমাদের বুঝিয়েছিলেন কীভাবে একজন মানুষকে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে হয়। তাঁর কথাগুলো এখনো আমার হৃদয়ে গেঁথে আছে।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক