অর্থ জানা থাক আর না থাক, বড় হতে হতে ‘ম’ ও ‘চ’ দিয়ে যত রকমের গালি আছে সবই দিতে পারে। শিশুর মুখে নোংরা গালি বড্ড বেমানান, তবে তার মানে এই নয়, অশ্লীল শব্দগুলো তারা কখনো শিখবে না। অন্তত ঢাকার বাসে নিয়মিত চলাচল করলে না শেখার কোনো কারণ নেই।
বাসে বাসে রেষারেষি নিত্যদিনের ব্যাপার। বাসের গায়ে আঁচড় যত সামান্যই হোক, চালকেরা একে অন্যের উদ্দেশে সর্বোচ্চ অপমানজনক শব্দটাই ছুড়ে দেন। এমনও দেখা যায়, কথা-কাটাকাটি করতে গিয়ে খালি রাস্তাতেও তারা জ্যাম বাধিয়ে বসেন। মাঝেমধ্যে তাদের দেখলে মনে হয়, গাড়ির সঙ্গে মুখ চালানোর নিয়ম বিষয়েও তাঁরা পাঠ নেন।
কয়েক দিন আগের ঘটনা। বাসের সামনের সিটে বসায় দেখতে পেলাম, দুই বাসের মাঝখান দিয়ে এক মাইক্রোবাস ঢুকে গেল। মাইক্রোবাসের চালক হঠাৎ করেই বাঁ থেকে ডানে এসেছেন। কয়েক সেকেন্ডের হেরফের হলেই বাসচালকের কিছু করার থাকত না। বাসের চালক রেগে গিয়ে মাইক্রোবাসের চালককে যে নামে সম্বোধন করল, সেটি একটু ভব্য ভাষায় বললে দাঁড়ায় ‘শূকরশাবক’।
হঠাৎ তাঁর খেয়াল হলো, এটা এসি বাস। কাচ সব লাগানো। ওই চালক কোন কদাকার প্রাণীর বাচ্চা, তা শুধু বাসের যাত্রীরাই শুনতে পাচ্ছে, মাইক্রোবাসের চালক তো আর শুনতে পারছে না! তাই ভুল শুধরে সে জানালার কাচ সরিয়ে গালি দিল। এতে কাজ হলো। শুনতে পেল মাইক্রোবাসের চালক। ব্যস্ত রাস্তা আটকে শুরু হলো ঝগড়া। ট্রাফিক পুলিশ চলে আসার পর তাঁরা মুখে লাগাম দিলেন।
কয়েক মাস আগের ঘটনা। কাউন্টারের সামনে দাঁড়াতে গিয়ে একটি বাস প্রাইভেট কারের ডান দিকে সামান্য ধাক্কা দেয়। যথারীতি দোষ এড়াতে আগেভাগে বাসের চালক সরে যেতে চেষ্টা করেন। প্রাইভেট কারের চালক বাসের সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করান। শুরু হয় ছাপার অযোগ্য ভাষায় গালাগালি। বাসচালক আবারও সটকে পড়েন। কিন্তু বিধি বাম! আবারও গাড়ি সামনে এনে বাস থামিয়ে দেন প্রাইভেট কারের চালক। গাড়ির পেছন থেকে বের করেন এক লাঠি। সমানে মারতে থাকেন বাসের গায়ে। রাগ তাতেও কমে না। ট্রাফিক পুলিশের কাছে অভিযোগ করলে তিনি এসে বাসচালকের কাগজপাতি নিয়ে যান।
আরেকবার সিএনজি অটোরিকশায় করে অফিসে যাচ্ছিলাম। জ্যামের মধ্যেই সিএনজির পেছনে ধাক্কা দিল বিশাল এক লরি। বিষয়টাকে সিএনজিচালক ব্যক্তিগতভাবে নিলেন। বারবার বলতে থাকলেন, ‘তুই আমার গাড়িতে ধাক্কা দিলি কিল্যাইগ্যা? জ্যামের রাস্তায় আগে যাইতে পারবি? যা, আগে যা, দেখি কেমনে যাইতে পারোস।’
এরপর সিএনজি নিয়ে তিনি সামনে এগোতে থাকেন ধীরে ধীরে, পেছনে থাকে লরি। কোনোভাবেই লরিচালককে আগে যেতে দেবেন না। এদিকে, লরিচালকের মাথা গরম হয়। লরি নিয়ে আসেন সিএনজির পাশে। গালাগালির আদান-প্রদান হতে থাকে বুলেটের গতিতে। আরেকটু হলেই মারামারি লাগে—এমন অবস্থা। সিএনজিচালক এবার বাংলা সিনেমার দৃশ্যে নিজেকে কল্পনা করে বলতে থাকেন, ‘যেতে হলে আমাকে মাইরা তারপর যা। কত্তো বড় সাহস, আমার গাড়িতে ধাক্কা দেয়!’ আমিও এবার মুখ খুললাম, ‘আপনাকে তো চেনে না। বেছে বেছে আপনার গাড়িতে ইচ্ছা করে ধাক্কা দিতে যাবে কেন? বহুত হইসে, অনেক নাটক করছেন এবার চলেন’।
চালকেরা হয়তো ধরেই নিয়েছেন, ভদ্রভাবে কথা বললে অন্য বাসের চালকের কানে তা পৌঁছায় না। তাঁদের জীবন গতিময়। হাজার হলেও গালির গতি বেশি। চলতি পথে নতুন একধরনের ভাষার সৃষ্টি কি হয়েই গেছে, যেখানে গালাগাল একেবারে সহজ–স্বাভাবিক? ভাষার মাসে প্রশ্নটা করে রাখলাম।
যাত্রীরাও তিতা কথা বলতে বেশ পারদর্শী। একবার বাসচালক খুব হার্ড ব্রেক করায় এক পুরুষ যাত্রী ভীষণ উত্তেজিত হয়ে বলতে থাকলেন, গাড়ি তো চালাইতে পারে না, অসুস্থ মনে হয়। একটু এগিয়ে চালক এক ট্রাকের চালকের সঙ্গে কথা বলছিলেন। এতেও সেই যাত্রী ক্ষিপ্ত হয়ে আজেবাজে কথা বলতে থাকেন। এবার চালক ধৈর্য হারিয়ে জানালেন, ওই গাড়ির সমস্যা ছিল। একটা পার্টস নড়বড়ে ছিল, বিষয়টা ট্রাকের চালককে জানাচ্ছিলেন। মহামূল্য এক বাণীও দিলেন, ‘রাস্তায় চলতে গেলে শুধু নিজের কথা ভাবলে চলে না। অন্যেরটাও ভাবতে হয়’।
লেখক: আনিকা জীনাত, সাংবাদিক