কিছুদিন আগে শ্রীলঙ্কায় যা ঘটেছিল তা যে পাকিস্তানে ঘটবে, ঘটতে পারে যে বাংলাদেশেও, সে নিয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশও সংগ্রহ করেছে, রপ্তানিতে যা আয় হয় আমদানি তা শুধু খেয়েই ফেলছে না, আরও খাব খাব করছে। আর রপ্তানির যে টাকা দেশে আসার কথা, তারও সবটা দেশে আসে না, অনেকটাই বিদেশেই রয়ে যায়। বিদেশে অর্জিত দেশবাসীর আয় থেকে যে টাকা দেশে আসার কথা, যে টাকা রওনাও হয়, সেই টাকার একটা অংশ ব্যাংকের মাধ্যমে না এসে হুন্ডির খপ্পরে পড়ে যায়। সর্বোপরি কোটি কোটি টাকা অকাতরে হরদম পাচার হয়ে যাচ্ছে। ঋণের ভারে জর্জরিত শ্রীলঙ্কাকে আরও ঋণের জন্য হাত পাততে হবে আগের ঋণদাতাদের কাছেই। হাত পাতা নয়, তোষামোদই করেছে আইএমএফকে। অবস্থা অনেকটা বাংলাদেশের সেই ক্ষুদ্রঋণ গ্রহীতাদের মতোই, যারা এক এনজিওর কাছ থেকে কর্জ করে আরেক এনজিওর কিস্তি শোধ করে থাকে। পাকিস্তানও গিয়ে হাজির হয়েছিল ওই একই প্রতিষ্ঠানের কাছে, পাত্র হাতে। তবে আইএমএফ কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠান নয়, পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান বটে। সুদের কারবারিও বলা যায়, বিশুদ্ধ বাংলায়। ঋণ দেয়, সুদ বুঝে নেয়। মূল টাকাও ফেরত চায়। সে জন্য কর্জ দেওয়ার আগে তারা জানতে চায় কর্জ নিচ্ছে যে তার সক্ষমতা আছে কি না কর্জ শোধ করার। মুখের কথায় সন্তুষ্ট হওয়ার বান্দা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চায়। বলে দেয় কোন কোন খাতে খরচ কমাতে হবে। নির্দেশ না মানলে মুখ ফিরিয়ে নেয়।
বাংলাদেশ যে আইএমএফের শরণাপন্ন হয়েছিল, সেটা সবাই জানে। কিন্তু তবু বাংলাদেশের সরকারি মুখপাত্র ও মন্ত্রীরা লুকোচুরির কসরত করছেন। যেমন জ্বালানি তেলের দাম হঠাৎ করেই শতকরা পঞ্চাশ ভাগ পর্যন্ত বাড়ানোর ব্যাপারটা। বোঝাই যাচ্ছে এটা করা হয়েছিল আইএমএফের নির্দেশে। কিন্তু বিভিন্ন কণ্ঠে বলা হচ্ছে, কারও নির্দেশে নয়, দাম বাড়ানো হয়েছে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সংগতি রাখার জন্য। নাকি এটি হলো দামের সংগতিবিধান। অথচ বিশ্ববাজারে কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম এখন আর বাড়ছে না, কমছেই। সরকারি লোকেরা যত বলে আইএমএফের ঋণের সঙ্গে দাম বাড়ানোর কোনো সম্পর্ক নেই, ততই মানুষ নিশ্চিন্ত হয়েছিল যে ঘটনাটা ঘটছে আইএমএফের পরামর্শে শুধু নয়; সুস্পষ্ট নির্দেশেই। জ্বালানি তেল থেকে ভর্তুকি কমিয়ে নেওয়া হয়েছিল; আভাস পাওয়া গিয়েছিল যে সরিয়ে নেওয়া হবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি থেকেও। কেননা অন্যথায় আইএমএফ ঋণ দেবে না। ব্যর্থতা সরকারের, ভোগান্তি অসহায় জনগণের।
আইএমএফের পরামর্শ নেওয়া চলবে না, নিলে দেশের সর্বনাশ ঘটবে, এই আওয়াজটা কিন্তু পুরোনো। বামপন্থীরা দিয়ে আসছে। ওয়ার্কার্স পার্টিও একসময় দিত। ওই পার্টি এখন সরকারি জোটেই রয়েছে, তবু তারাও দেখছি, পুরোনো অভ্যাসে কি না জানি না, বলেছিল তেলের দাম বাড়ানোটা হচ্ছে সরকারের জন্য বিষ খাওয়ার শামিল; সেই বিষ এখন ছড়িয়ে পড়বে সর্বত্র। এমনকি চিন্তিত হয়েছিল সরকারি জোটের অন্তর্ভুক্ত জাসদও (ইনু)। সরকারের অনুগত বিরোধী দল জাতীয় পার্টি বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছিল, মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন ও নির্দয়। তাদের সবারই অভিযোগ ছিল, তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের সলাপরামর্শ করা হয়নি; সিদ্ধান্ত পুরোপুরি আমলাদের পরামর্শে। মন্ত্রীদের অধিকাংশই নাকি টের পাননি যে ইতিহাস-কাঁপানো এ রকম একটি সিদ্ধান্ত আসছে। তাঁরা অনেকেই চুপ করে ছিলেন। নেতাদের দু-এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছিলেন যে এসব ক্ষেত্রে চুপ করে থাকাটাই শ্রেয়। সমালোচনা করলে সরকার চটবে, প্রশংসা করলে জনগণ মনে করবে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেওয়া হচ্ছে। তবে কাউকে কাউকে তো কথা বলতেই হয়। যেমন তথ্যমন্ত্রীকে। তিনি অনেক খবর রাখেন এবং দেশবাসীকে তা অহরহ জানানও। তিনি জানাচ্ছেন, জ্বালানি তেলের দাম আমাদের দেশে এখনো অনেক দেশের তুলনায় কম। শুনে মানুষের আহ্লাদিত নয়, ভড়কে যাওয়ারই কথা। দাম এখনো কম মানে কি আগামীতে আরও বাড়ানো হবে? এটা কি হুমকি, নাকি পূর্বাভাস? নাকি দুঃখ প্রকাশ দাম বাড়ানোর ব্যাপারে আমরা এখনো অনেক দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছি বলে? বাণিজ্যমন্ত্রী অবশ্য ভালো একটা পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ধৈর্য ধরার। বলেছিলেন, ‘সুদিনের জন্য কষ্ট করতে হয়, মানিয়ে নিন।’ প্রবচন আছে সবুরে মেওয়া ফলে, তবে এটাও তো জানা আছে সবারই যে অধিক প্রতীক্ষায় মেওয়া শুকিয়েও যায়। তা ছাড়া, জুতার মাপে পা ঠিক করে নিন, পরামর্শ হিসেবে এটা কি খুব আশাব্যঞ্জক? প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টার বক্তব্য ছিল: ‘মূল্যবৃদ্ধির কষ্ট আমাদের সহ্য করতে হবে।’ এসব উক্তির ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যায়, আমরা বলতে কাদের বোঝানো হচ্ছে, সরকারি গাড়িতে চড়ে যাঁরা চলাফেরা করে থাকেন তাঁদের, নাকি রৌদ্রে ঘেমে, বৃষ্টিতে ভিজে ঠেলাধাক্কা সহ্য করে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাঁরা পাবলিক বাসে যাতায়াত করেন, সেই মানুষদের?
এরই মধ্যে খুবই চাঞ্চল্যকর একটি তথ্য দিয়েছিলেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি জানিয়ে ছিলেন যে আমরা বাংলাদেশিরা রীতিমতো বেহেশতে বসবাস করছি। বেহেশত অবশ্য নানা প্রকারের হয়ে থাকে বলে শুনেছি; তবে তিনি কোন বেহেশতের কথা বলেছিলেন, সেটা নির্দিষ্ট করে বলেননি। বেহেশতে কে না যেতে চায়, আমরা সাধারণ মানুষেরাও বিলক্ষণ যেতে চাই; তবে পথের সন্ধান জানি না। এমনকি বোকার স্বর্গে যে বসবাস করব, সেই সুখও পাই না। আমরা, অধিকাংশরা তো ওই সব আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে বসে আছি। ভরসায় থাকি পরকালে যদি কিছু জোটে। তবে যাঁরা স্বর্গে বসবাস করছেন, তাঁদের ওই সুখে আমরা ঈর্ষায় কাতর না হয়ে বরং খুশিই হব; হাজার হোক তাঁরাও তো আমাদের প্রাণপ্রিয় এই বাংলাদেশেরই মানুষ। থাকুন, তাঁরা ভালো থাকুন। তবু বলি, নিজেদের সুখের খবর যন্ত্রণাকাতর মানুষকে না জানালেই ভালো করবেন, হাজার হোক আমরাও মানুষ তো।
বস্তুত উন্নতির কথা আমরা শুনছি বটে, চর্মচক্ষে উন্নতি যে দেখছি না এমনও নয়; তবে উন্নতির ভেতরটা কেন জানি ফাঁকা মনে হয়। যেমন শতভাগ মানুষের কাছে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার সাফল্যের কথা আমরা শুনেছি এবং রীতিমতো উৎফুল্ল হয়েছি, কিন্তু এখন দেখছি লোডশেডিংয়ের সেই পুরোনো উৎপাত দিব্যি সশরীরে এসে হাজির হয়েছে।
আমরা শুনেছি খাদ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছি, কিন্তু তারপরও দেখছি খাদ্য আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে। পেঁয়াজ হতে বিভিন্ন সবজি দেশেই উৎপাদিত হয়, কিন্তু তার কেজি নাকি এক শ টাকার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছেছে। দেশের বিশ্বখ্যাত ক্রিকেট বীরেরাও অতটা স্কোর করতে পারেন না, খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যতটা করতে পেরেছে, নির্বিঘ্নে। বেকারত্বের কথা নাই-বা স্মরণ করলাম; সে তো নিত্যদিনই ব্যঙ্গ করছে উন্নতির বয়ানকে। জ্বালানির ব্যাপারেও দেখা যাচ্ছে নতুন গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান করা হচ্ছে না, চলছে তরল গ্যাস আমদানি। অপরিশোধিত জ্বালানি তেল শোধনাগারের ধারণক্ষমতা নাকি গত ৫৩ বছরে এক ইঞ্চিও বাড়ানো হয়নি; তার মানে পাকিস্তান আমলে যেখানে ছিল, সেখানেই রয়েছে। ওদিকে অন্য ক্ষেত্রে যেমন জ্বালানির ক্ষেত্রেও তেমনি, লুণ্ঠন, দুর্নীতি ও ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা পরস্পরের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলকভাবেই অগ্রসর হয়েছে।
লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়