হোম > ছাপা সংস্করণ

সুরুচি বনাম কুরুচি

অজয় দাশগুপ্ত

রুচি নিয়ে দেশ তোলপাড়। রুচি, কুরুচি ও সুরুচি—এই তিনের সঙ্গে আমাদের পরিচয়, ওঠাবসা আজীবনের। আজকাল রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে—এটা সবাই মানেন, বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আসার পর থেকে মানুষ নানা কারণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বেপরোয়া বা লজ্জাহীনতার কারণ ‘আনএডিটেড’ বা ‘সম্পাদনাহীন’ মিডিয়া।

আমরা যারা খবরের কাগজ কিংবা অন্য মাধ্যমে লিখে বড় হয়েছি, সবাই জানি সম্পাদনার সুফল কী। একটা পত্রিকা বা গণমাধ্যম দেশ তোলপাড় করে দিতে পারে। ভালোভাবে যেমন, তেমনি খারাপভাবেও তার প্রভাব অপরিসীম। আমাদের সমাজ ও দেশ তা জানে। তার প্রমাণ বহুবার পেয়েছি আমরা। তাই জাতীয় বা আন্তর্জাতিক মিডিয়া সাবধান থাকে। তাদের আচার-আচরণ হয় নিয়মতান্ত্রিক।

অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নামের ফেসবুক, টুইটার বা অন্য কিছু খোলা (ওপেন) মিডিয়া। যে যা খুশি লিখতে পারে, আবার লিখে তা মুছেও দিতে পারে। এই মনে হলো কাউকে ‘স্যার’ বলি, আবার একটু বাদে তাকেই হয়তো তিরস্কার করছে একই লোক। এমন সব মানুষও আছে যাদের কাজ হচ্ছে দেশের নামকরা মানুষজনকে রোজ একবার করে ভর্ৎসনা করা। এই সব পোস্টে অজস্র মানুষের লাইক, লাভ, আর কমেন্টে তাদের পোয়াবারো। সংগত কারণেই তারা বুঝে যায়, এটাই মানুষ খায়! এমন মনস্তত্ত্ব আর যা-ই হোক, সমাজের মঙ্গল করতে পারে না।

ইদানীং আরেকটি ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে যৌনতা। প্রায়ই দেখি এটা ভাইরাল, ওটা ভাইরাল। মানুষের প্রাইভেসি এমনভাবে আর কোনোকালে লঙ্ঘিত হয়েছে বলে মনে হয় না। যারা এসব ধারণ করে, তারাও কিন্তু সমান অপরাধী। আর একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার, এরা কেন করে এবং কীভাবে করে? খুব সহজেই বোঝা যায়, এসব করে নিজেদের অপ্রাপ্তি আর রাগ বা কারও প্রতি বিদ্বেষ থেকে। কোনো রুচিমান মানুষ নিজের টাকা খরচ করে ঝুঁকি নিয়ে এসব ধারণ করতে পারে না। আরেকটা কারণ, এরাও একই পথের যাত্রী। তাই তারা জানে কার সঙ্গে কার অবৈধ সম্পর্ক বা পরকীয়া। এসব সমস্যা আগেও ছিল। কিন্তু এমনভাবে প্রচার পেত না। আমি এর উল্লেখ করার কারণ রুচির অভাব কীভাবে বাড়ছে তা বোঝানো। কোনোভাবেই যৌনতাকে সমর্থন করি না। অবৈধ কোনো কিছু সমর্থন করার কারণও নেই। কিন্তু এই প্রবণতা নিয়ে মানুষকে বিপদে ফেলা যেমন অসমর্থনযোগ্য, তেমনি যৌনতার যথেচ্ছ ব্যবহারও চাই না আমরা।

আমাদের দেশে একসময় ছোটদের জন্য কতগুলো সংগঠন ছিল। তারা ছোটদের জন্য, কিশোর-কিশোরীদের জন্য কাজ করত। এমনই একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় আমরা ছেলেবেলা থেকেই শিখেছিলাম সম্মান আর ভালো লাগার তফাত কোথায়। আমাদের যৌবন বা তারুণ্যে আরেকটা বিষয় ছিল—বিশ্বাস। কম ছিল সবজান্তা মানুষ। সবজান্তাদের ভিড়ে এখন আমাদের নাভিশ্বাস ওঠার মতো হাল। একটা সামাজিক অ্যাকাউন্ট থাকলেই হলো। পরদিন থেকে তিনি কবি, সাহিত্যিক, নাটকের লোক বা শিল্পী। সমাজ ও সামাজিক মিডিয়া একে অপরকে ঋদ্ধ করছে, করবেও; কিন্তু এই প্রবণতা মূলত রুচির বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। আমার ধারণা, রুচির অবমূল্যায়নের জন্য আমরা হিরো আলমকে দায়ী করলেও মূলত দায়ী সমাজের অচলায়তন। কেউ বুঝতে চায় না আমরা কোথায় ছিলাম আর কোথায় যাচ্ছি।

ইউটিউবে নানা ধরনের ভিডিও আছে। সে রকম একটিতে দেখলাম, এক ভদ্রলোক সাধারণ জনগণের কাছে গিয়ে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্টের নাম জানতে চেয়েছেন। একজন ছাড়া বাকি কেউ উত্তর দিতে পারেনি। শুধু তা-ই নয়, প্রতিটি উত্তর ছিল ভুল ও অদ্ভুত।

দেশের প্রেসিডেন্টের নাম জানতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। না জানলেও চলে কিন্তু আপনি যদি প্রধানমন্ত্রী বা অন্য কাউকে প্রেসিডেন্ট মনে করেন, তাহলে তো প্রশ্ন থেকে যায়, আপনি কোন দেশে বাস করেন?

রুচির আরও ঘাটতি আছে। গান-বাজনা, নাটক সবকিছু নষ্টদের দখলে। নষ্ট বলতে কেবল প্রান্তিক মানুষদের দিকে আঙুল তুললে হবে না। বড় মানুষেরা সমাজের এই অধঃপতনে কী করছেন? তাঁদের দায়দায়িত্ব কি শেষ? পদ, পদক, পদবির বেড়াজালে ধুঁকছে সংস্কৃতি। তাই কোনো খাতে সুষম বিকাশ নেই। আজকাল গানের কথা শোনা দায়। নাটকের সংলাপ বদলে গেছে অনেক আগে। এই যে প্রমিত বাংলার সম্মান নষ্ট করে ভুল বাংলায় কথা বলা, এর প্রচলন কি কোনো গরিব সাধারণ মানুষ করেছে? এর জন্য দায়ী নামকরা কিছু পরিচালক। যাঁরা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য নাটকে ভাষার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন। অথচ তাঁরা অগ্রগণ্য!

রুচির অভাব রাজনীতিকেও ছেড়ে কথা বলছে না। বলছে না বলেই আজকাল কে কার সঙ্গে লড়বে বা প্রতিযোগিতা করবে, কেউ জানে না। গুলশানের দিকে তাকালেই টের পাবেন। শুধু তা-ই নয়, অন্য প্রার্থী যত ছোট, বড় কিংবা রুচিহীন হোক না কেন, এখন এমন একটা সময় এসেছে যে তাঁর বিরুদ্ধে ন্যায্য কথা বললেও আপনার খবর আছে! সামাজিক মিডিয়ার কথিত গরিব দরদিরা আপনার নামে এমন সব গুজব ছাড়বে যে আপনি ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ বলে পার পাবেন না।

শীর্ষ নেতা থেকে দরিদ্র সাধারণ মানুষ তো বটেই, পেঁয়াজ-মরিচ-আদা কেউ বাদ নেই। সবাই এই রুচিহীনতার শিকার। কাঁচা মরিচ নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে ট্রল দেখে মনে হবে সবাই একেকজন মরিচ উৎপাদনকারী বা ব্যবসায়ী। আমি সত্যি বলছি, পৃথিবীর কোনো সমাজে এমন করে সবাই মিলে সব বিষয়ে মতামত রাখার প্রবণতা দেখি না, যা আমাদের বেলায় হচ্ছে। এর কারণ কি মিডিয়ার দুয়ার খুলে যাওয়া? না, আমরা আসলেই অপ্রস্তুত একটি জাতি যারা ডিজিটাল মিডিয়ার মানে বুঝি না।

অথচ আপনি দেখেন, কলকাতা যেখানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সফল, আমরা সেখানে রোজ হিমশিম খাচ্ছি। আর এর ফলে মানুষ মরছে। শিশুরা আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ সে বিষয়ে রুচিমানেরা নীরব। স্টার জলসা বা জি বাংলার সিরিয়াল ও তার প্রভাব নিয়ে সরব নেটপাড়া ভালো বিষয়ে চুপ থাকে। ভালো কোনোটাই নিতে পারি না আমরা। প্রধানমন্ত্রীর এত কাজ, এত ভালো দিক, সেদিকে কারও নজর আছে? সবাই মিলে এমন এক রুচি তৈরি করতে চায় যেন আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনাই সব সমস্যার মূল। কাউকে সমর্থন করে, না করেও আপনি হবেন রুচিহীনতার শিকার। এ বিষয়ে আওয়ামী, নন-আওয়ামী সবাই এক পা এগিয়ে।

মূলকথা হলো, রুচি ও মননের জন্য দরকার পাঠ। দরকার সুস্থ বিনোদন। চাই ভালো পরিবেশ ও সঠিক মেধার উত্তরণ ও সাফল্য। এর কোনোটাই নেই। তাই এত হাহাকার। রুচি কখনো একবার হারালে পুনর্বার সেভাবে ফিরে আসে না। পাশ্চাত্যের লেখক, দার্শনিক, সমাজবিদেরা বলেন, কোনো অবস্থাতেই রুচি ও মননের বিসর্জন না দিতে। তাহলে আপনার হয়তো টাকা হবে, আপনি ধনী হবেন, কিন্তু ‘বড়লোক’ হতে পারবেন না। এ কথাগুলো আমরা জানি। আমাদের দেশে একসময় তা মানা হতো। এখন হয় না বলেই টাকা আছে, রুচি নেই। মনে, মুখে, ভাষায় না থাকলেও চানাচুরে মনে হবে রুচি আছে, আছে না?

লেখক: অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ