হোম > ছাপা সংস্করণ

চীনের উন্নয়ন প্রস্তাব, চিন চিনে ভাবনা

অজয় দাশগুপ্ত

বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ও সহায়তা ইতিমধ্যে আমেরিকা, ভারত, ইউরোপসহ বিশ্বের নজর কেড়েছে। এবার একটা খবর দেখে পুলকিত এবং বিস্মিত হয়েছি। খবরটা এমন: চীনের চারটি রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি নিজেদের খরচে চট্টগ্রামে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়নের একটি প্রস্তাব দিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) কাছে। বিনিময়ে মিরসরাইয়ের কাছে সাগর থেকে উদ্ধার করা জমিতে তারা একটি স্মার্ট সিটি বানিয়ে সেখান থেকে লভ্যাংশ নিতে চায়। প্রস্তাব পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সিডিএ কর্মকর্তারা বলছেন, মেট্রোরেল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইও নিজেদের খরচে করার প্রস্তাব দিয়েছে চীনা কোম্পানিগুলো। বিষয়গুলো তাঁরা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারকে জানাবেন, সিদ্ধান্ত যা নেওয়ার সরকারই নেবে।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী বলেন, ‘আমাদের বে টার্মিনালের যে নির্ধারিত স্থান, তার পর থেকে মিরসরাই পর্যন্ত সাগরের মধ্যে একটি চরের মতো আছে। ওই জায়গায় সাগরের জমি রিক্লেইম (ভূমি উদ্ধার) করে তারা টাউনশিপ (উপশহর) করতে চায়।’

আমাদের দেশে বিদেশিরা বিনিয়োগ করবেন—এটাই সবার চাওয়া। এককালে খালি ঝুড়ি বা তলাহীন বাস্কেট নামে পরিচিত বাংলাদেশের ঝুড়ি উপচে পড়লে আমাদের চেয়ে খুশি আর কে হবে? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের উন্নতি আর অগ্রযাত্রা এখন দৃশ্যমান। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে উন্নয়ন বা যে অগ্রগতি সাধারণ মানুষকে ভালো রাখবে না বা শান্তি ও সচ্ছলতা দেয় না, তার পথ কি মসৃণ, না তা আখেরে টেকসই হবে? এমন বলি না যে বাংলাদেশের উন্নয়ন বা অর্জন টেকসই না; বরং এখন বেশ কিছু জায়গায় চোখ ধাঁধানো ব্যাপার চোখে পড়ে। আর সেটাই ধাঁধা। কারণ আমাদের সব উন্নয়ন আর অগ্রগতি যেন মহাসড়ক বা উড়ালসেতু কিংবা ব্রিজের পিলারে আটকে আছে। তা না হলে আজ কদিন ধরে দেশের সব মিডিয়ায় ন্যায্যমূল্যে টিসিবির দোকানে পণ্য কেনাবেচা এবং মধ্যবিত্তের মুখ লুকিয়ে লাইনে দাঁড়ানোর খবর কেন শিরোনাম? এমনও লিখছে, লজ্জা-শরমের মাথা খেয়ে তারা আজ ন্যায্যমূল্যে জিনিস কেনার জন্য মরিয়া। লাইনে দাঁড়ানো অপরাধ নয়; বরং সবারই অধিকার আছে সঠিক দামে, কম মূল্যে পণ্য কেনার। কিন্তু আমাদের সমাজকাঠামো এমন, এসব সস্তা বা সরকারি ন্যায্যমূল্যের দোকানের লাইন মানেই অসহায়, চলতে না পারা অভাবী মানুষের ভিড়। আর সেই লাইনে যাঁরা দাঁড়ান তাঁরা হয় করুণার পাত্র নয়তো অবহেলার। প্রশ্ন হচ্ছে, সরকারি দলের নেতাদের কথামতো দেশ যদি সিঙ্গাপুর হয়ে গিয়ে থাকে, তো এমন হাল দেখতে হচ্ছে কেন?

এই ডামাডোলের ভেতরই এমন একটা খবর। যেখানে আমাদের চট্টগ্রামের চেহারা আমূল বদলে যাওয়ার পূর্বাভাস দেখতে পাচ্ছি। গোড়াতেই বলি, চীন কোনো কাঁচা কাজ করে না। আর পৃথিবীতে চীনা বুদ্ধি বলে যে কথাটা চালু, তার মর্মার্থ হচ্ছে কূটকৌশল। আমরা হংকং, তাইওয়ান, ম্যাকাউ—এসব স্থানের অতীত বা এদের দিকে তাকালেও অনেক প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাব। কিন্তু সবার আগে আমি বলব শ্রীলঙ্কার কথা। শ্রীলঙ্কার দক্ষিণাঞ্চলীয় হাম্বানটোটা ১১০ কোটি ডলারের বিনিময়ে গভীর সমুদ্রবন্দরের নিয়ন্ত্রণ এবং উন্নয়নের জন্য চীনের সঙ্গে একটি চুক্তি করেছে দেশটির সরকার। চীনা সামরিক বাহিনী বন্দরটি ব্যবহার করতে পারে—মন আশঙ্কা থেকে চুক্তিটি কয়েক মাস বিলম্বের পর স্বাক্ষরিত হলো। সরকার নিশ্চিত করেছে যে শুধু বাণিজ্যিক কাজেই চীন বন্দরটি ব্যবহার করবে, মূলত এশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজ চলবে এই বন্দর দিয়ে। শ্রীলঙ্কা সরকার বলছে, এই চুক্তি থেকে পাওয়া অর্থ তাদের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে সাহায্য করবে।

২০১৭ সালে সম্পাদিত চুক্তি আজ কোথায় গিয়ে ঠেকেছে? সে দেশের সরকার ও রাজনীতি চীন-বিতর্কে দুই ভাগে বিভক্ত। একদিকে বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের উষ্মা, অন্যদিকে সময়মতো টাকা পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে বন্দরগুলো এক শ বছরের জন্য হাতছাড়া। যার মানে ওই এলাকা এখন প্রচ্ছন্নভাবে চীনের আওতায়। সবাই জানে চীন একবার ঢুকলে তাকে ঠেকানোর সাধ্য নেই কারও। সেই শক্তি স্বয়ং আমেরিকারও নেই। তারা মুখে যা-ই বলুক, ভেতরে-ভেতরে চীনের শক্তি সম্পর্কে জানে বলেই পা বাড়ায় না।

কমিউনিস্ট নামে দেশ শাসন করলেও চীন মূলত একনায়কতান্ত্রিক পার্টিনির্ভর একটি অচলায়তনের দেশ। তার চোখ ধাঁধানো উন্নতি বা আর্থিক শক্তির পাশাপাশি গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই সেখানে। সেখানকার মানুষজন পরিশ্রমী। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি এরা রোবটের মতো। সবচেয়ে বড় কথা, সেলফিশ বা আত্মকেন্দ্রিক। দরকারের সম্পর্ক শেষ হলে তারা আর কাছে থাকবে না। তখন চীনের অন্য চেহারা। যে প্রস্তাবটি তারা বাংলাদেশকে দিয়েছে, তাতে মনে হলো উপশহরটির জমি তারা কীভাবে কাকে দেবে বা বিক্রি করবে, সেটা তাদের হাতেই থাকবে। যদি তা-ই হয়, আমাদের দেশের ভেতর এটি হতে পারে ছোট চীনা উপশহর। কৌশলগত কারণে বা জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য তারা এখানে আসতেই পারে। কিন্তু চীনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, সাগরের জমি উদ্ধার করে যে ‘স্মার্ট সিটি’ তারা গড়তে চায়, তার দায়িত্ব তাদের হাতেই থাকবে। সেখানে প্লট বিক্রির টাকা তারা বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে ভাগাভাগি করবে।

টাকা ভাগাভাগি করা এক বিষয় আর নিয়ন্ত্রণ কার কাছে থাকবে, সেটা ভিন্ন। চীন কখনো বিনা লাভে কোনো কাজ করবে না। এই যে তারা মেট্রোরেল বানিয়ে দেবে বলছে, এই হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প কোনো পাগলও কি বিনা খরচে করে দিতে চাইবে? তার মানে এর জন্য তাদের আলাদা পরিকল্পনা আছে। যার বহিঃপ্রকাশ সমুদ্রের জমি নিয়ে তাতে উপশহর বানানো।

মনে পড়ে সমুদ্রসীমা বিচারে বাংলাদেশ যখন ভারতের কাছ থেকে কিছু জমি পেয়েছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এগুলো বাংলাদেশের জনসংখ্যার চাপ কমানোসহ দেশের আয়তন বাড়াতে সাহায্য করবে; যা আমাদের জন্য জরুরি। কিন্তু চীন কি সে উদ্দেশ্য পূরণ করবে, না তা সম্ভব?

একটু অতীতে তো ফিরতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধে আমরা পরাজিত হলে চীন আমাদের পাশে থাকত না। শুধু কি তাই? চীনা বুলেটের আঘাতে মৃত হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের রক্তে রাঙা মাটি আমাদের। সেই মাটিতে বিনয় ও মানবিক গুণাবলির চেয়ে অধিক রোবট একটি ভিন ভাষা, ধর্ম ও আচারহীন মানুষজনের বসতি বা আগমন কতটা সাংঘর্ষিক হতে পারে, সেটা কি ভাবা হবে না? সাহায্য-সহায়তা আর বন্ধু হয়ে পাশে থাকা এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বন্ধুত্ব ভিন্ন দুটি বিষয়। আমাদের দেশে কমন-ভারত বিরোধিতা আর তাদের আগ্রাসনের নামে যে রাজনীতি, তা আশ্চর্যজনকভাবে চীনের বিষয়ে সব সময় নীরব। কিন্তু সময় তো চুপ থাকবে না।

একদিকে যেমন লোভনীয় বাণিজ্যিক ও উন্নয়নগত প্রস্তাব, অন্যদিকে ভয়াবহ ধরনের সতর্কতা আর সাবধানতার দরকার। সরকার নিশ্চয়ই সব বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবে এবং যা হবে জনকল্যাণকর। চীনের কারণে ভারত, আমেরিকা, ইউরোপসহ অন্যদের চটানো বা তাদের রোষানলে পড়ার বিষয়টিও ভাবার মতো বৈকি।

অজয় দাশগুপ্ত, অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ