হোম > ছাপা সংস্করণ

আমরা সবাই নেতা... ­

মহিউদ্দিন খান মোহন

আমার এক শ্রদ্ধাভাজন বড় ভাই মোহাম্মদ জয়নাল আবেদীন একসময় ছাত্ররাজনীতি করতেন। পড়াশোনা শেষে কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। ডিএমডি হিসেবে অবসরে গেছেন কয়েক বছর আগে। বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী তিনি। এবার মহান বিজয় দিবসে গিয়েছিলেন জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে। যাওয়া-আসার পথে রাস্তার দুই ধারে অসংখ্য ফেস্টুন, ব্যানার আর বিলবোর্ডের সমারোহ দেখে তাঁর মনে জন্ম নেওয়া প্রশ্ন শেয়ার করেছেন ফেসবুকে। তাঁর জিজ্ঞাসা—এত নেতা এল কোত্থেকে?

জয়নাল সাহেবের অবাক হওয়ারই কথা। কেননা, তাঁরা যখন রাজনীতি করতেন, তখন নেতা-কর্মীদের আত্মপ্রচারের কোনো অবকাশ ছিল না। দলের আদর্শ প্রচার করতে করতেই তাঁরা গলদঘর্ম হতেন। কর্মী হিসেবে কাজ করতে করতে একসময় নেতার অবস্থানে পৌঁছে যাবেন—এমন আশা করতেন তাঁরা। তবে পোস্টার-ব্যানার দিয়ে নিজেকে নেতা হিসেবে জাহির করার প্রবণতা সে সময় কারও মধ্যে ছিল না। আমরা যখন ছাত্ররাজনীতি করেছি, কর্মী হিসেবে দলে কাজ করার সুযোগ পেয়েই নিজেদের ধন্য মনে করতাম। তবে এখন যুগ পাল্টেছে। সেই সঙ্গে পাল্টে গেছে অনেক কিছুই। এখন আর কেউ নিজেকে দলের কর্মী বলে পরিচয় দিতে চায় না। নেতা হতে চায়।

ফলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে এখন কর্মী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে। আর নেতার এই অতিসমাগমে ঘটছে নানা অঘটন, অপ্রীতিকর ঘটনা।

তেমনি একটি ঘটনা ঘটে গেল ৬ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে। অতিথি নেতারা ছাড়াও এত বেশি নেতা মঞ্চে ছিলেন যে তা হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। আহত হন প্রধান অতিথি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ বেশ কয়েকজন। ঘটনার পরে তিনি বলেছেন, ‘এত নেতা দরকার নাই, কর্মী দরকার।’ এত দিন আমরা অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই নৌযান ডুবে যাওয়ার ঘটনা শুনেছি, দেখেছি। এবারই প্রথম অতিরিক্ত নেতা বোঝাই মঞ্চ ভেঙে পড়ার ঘটনা প্রত্যক্ষ করলাম। ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, জন্ম দিয়েছে মুখরোচক আলোচনারও। কেউ কেউ এটা নিয়ে হাস্যরস করছেন। কিন্তু এটা হাস্যরসের বিষয় নয় বলেই আমি মনে করি। এ ঘটনা আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। কেননা, রাজনীতিতে এখন ‘বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়’ অবস্থা। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সব রাজনৈতিক দলের একই অবস্থা।

আমাদের যাঁরা লিজেন্ড পলিটিশিয়ান, তাঁরা কথা বলার সময় এখনো নিজেকে দলের কর্মী হিসেবেই পরিচয় দেন। কিন্তু এই প্রজন্মের কর্মীরা সে পরিচয় দিতে অনিচ্ছুক। তারা নেতা হিসেবে পরিচিত হতে পাগল। তাদের এই উন্মাদনা এমন সব ঘটনার জন্ম দেয়, যা মানুষের বিরক্তি উৎপাদন করে। একটি টিকটক ভিডিও ক্লিপ দেখলাম সেদিন ফেসবুকে। এক ছেলে সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছে, আর একে ওকে বলছে, আমি নেতা হইছি। আমাকে সবাই নেতা মানবা। সঙ্গী মোসাহেবরা কখনো মাথা নেড়ে, কখনো নেতার কথা পুনরাবৃত্তি করে সায় দিচ্ছে। ওই নেতা একজনকে বলছে, এই তো দশ মিনিট আগে আমার মোবাইলে মেসেজ পাঠাইছে, আমি কমিটি পাইছি। এখন থেকে আমারে সালাম দিবা। উঠতে-বসতে সালাম দিবা। হুদাহুদি সালাম দিবা।

আর এখন থিকা আমারে ডরাইবা। আমারে আইতে দেখলে মনে করবা বাঘ আইতাছে, বোঝছ? ভিডিও চিত্রটিতে আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতির একটি বাস্তব চিত্র যে তুলে ধরা হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু কেন এদের মধ্যে নেতা হওয়ার এমন প্রবণতা? কারণ, নেতা হওয়ার অনেক সুবিধা। দল ক্ষমতায় থাকলে তো কথাই নেই। না থাকলেও ‘সামনে ক্ষমতায় আসছি’ এই কবজ ঝুলিয়ে মানুষের কাছ থেকে সমীহ আদায় করা যায়।

 নেতা হিসেবে নিজেকে জাহির করার আরেকটি পদ্ধতি অধুনা খুব বাজার পেয়েছে। নিজের বড় সাইজের ছবিসংবলিত রংবেরঙের ফেস্টুন-ব্যানার গাছের ডাল, ল্যাম্পপোস্ট কিংবা কোনো স্থাপনার পিলার বা দেয়ালে ঝুলিয়ে দিয়ে মানুষকে জানিয়ে দেওয়া যায় সে কত বড় নেতা। সদ্য উদ্বোধন করা মেট্রোরেলের পিলারে এমন অসংখ্য পোস্টার-ব্যানার লাগানোর বিষয়টি মিডিয়ায় উঠে এসেছে।

সৌন্দর্যবিনাশী এ কাজের জন্য জাতীয় পার্টির একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নোটিশ পর্যন্ত করেছে। ওই নেতা অবশ্য ‘আওয়ামী লীগের আরও বেশি পোস্টার আছে’ বলে নিজেরটা হালাল করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একটি খারাপ কাজের উদাহরণ কি আরেকটি খারাপ কাজকে জায়েজ করতে পারে?

কেউ কেউ আবার দলের ওয়ার্ড কমিটিতেও নতুন পদ পেলে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দেয়ালে পোস্টার লাগায়, গাছে ব্যানার-ফেস্টুন ঝোলায়। ওই সব ব্যানারে লেখা থাকে ‘অমুক’কে ‘ওই পদে’ নির্বাচিত করায় দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেক্রেটারিকে ধন্যবাদ। ভাবটা এমন, যেন দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি-সেক্রেটারি তাঁকে ভোট দিয়ে ওই পদে নির্বাচিত করেছেন। নিজেকে জাহির করার কী অভিনব কৌশল! ওই সব পোস্টার-ফেস্টুনের দিকে তাকালে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করবেন, সেগুলোতে বিভিন্ন স্তরের এত নেতার ছবি দেওয়া হয় যে দলের মূল নেতা-নেত্রীর ছবি পড়ে থাকে এক কোণে, অতিক্ষুদ্র আকারে। দেখতে হলে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে। আমার বোধে আসে না দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কেন এসব বেয়াদবি মার্কা তৎপরতা বন্ধের উদ্যোগ নেয় না।

মঞ্চে নেতাদের এই ভিড় আগে দেখা যেত না। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের ভিডিও রেকর্ড দেখুন, তাঁর পেছনে একমাত্র দেহরক্ষী ছাড়া আর কেউ দাঁড়ানো ছিল না। কেন তখন কি কোনো নেতা ছিল না তাঁর পাশে দাঁড়ানোর মতো? অবশ্যই ছিল। কিন্তু নেতার প্রতি সম্মানবোধের কারণেই তাঁরা অমনটি করেননি। চেহারা দেখিয়ে ‘বিখ্যাত’ হওয়ার জন্য নেতার পাশে গিয়ে দাঁড়াননি। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী অসংখ্য জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। তাঁর পেছনেও নেতা-পাতি নেতাদের ভিড় করে দাঁড়াতে দেখা যায়নি। নেতা ভাষণ দেবেন, আর তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে দশ-বিশজন উঁকিঝুঁকি মারবে, তা তখন ভাবাই যেত না। এখন দেখা যায়, একজন নেতা বক্তৃতা দেন, তাঁর পেছনে দাঁড়ানো নেতায় মঞ্চ গিজগিজ করে। অনেক সময় পাতিনেতাদের ভিড়ে বক্তৃতারত মূল নেতাকে আবিষ্কার করাই মুশকিল হয়ে পড়ে। আবার দেখা যায়, নেতা হয়তো সাংবাদিকদের ব্রিফ করছেন, আর তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে কোনো পাতিনেতা মাথা নেড়ে কথায় সায় দিচ্ছেন। মঞ্চে মুখ-মাথা দেখিয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বানানোর এ অপকৌশল আজ রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আর এ কারণেই ওবায়দুল কাদেরসহ মঞ্চটি ভেঙে পড়েছে। ক্ষুব্ধ ওবায়দুল কাদের অবশ্য বলেছেন, ‘এমন নেতার দরকার নাই।’ কিন্তু এই কুপ্রবণতা বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ তিনি বা তাঁরা নিতে পারবেন, সে ভরসা কম।

আমাদের যাঁরা প্রাতঃস্মরণীয় রাজনীতিবিদ, তাঁরা সবাই একেবারে তৃণমূল কর্মী থেকে ধীরে ধীরে আপন কর্মের গুণে নেতা হয়েছেন। কিন্তু আজকাল অনেকেই কর্মী না হয়েই নেতার কুরসিতে বসতে চান। ভাবখানা এই, যেন নেতা হওয়ার জন্যই তাঁরা এই ধরাধামে তাশরিফ এনেছেন। তাঁদের নেতা হওয়ার উদগ্র বাসনা দেখে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’ গানের অনুকরণে গলা ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করে, ‘আমরা সবাই নেতা আমাদের এই নেতার রাজত্বে, নইলে মোরা নেতার পাশে বসব কী স্বত্বে’।

লেখক:সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ