আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। যারা ক্ষমতায় আছে তারা আরেক দফা ক্ষমতায় থাকার জন্য ছক কষছে। আর যারা ক্ষমতায় যেতে চায়, তারাও পরিকল্পনা করছে মিত্র বাড়িয়ে নিজেদের শক্তি দেখানোর। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় যেতে চায় বিএনপি। এই দুটি দলই দেশে ভোটের রাজনীতির বড় ফ্যাক্টর। এর বাইরে কিছু ভোট আছে জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামীর। জাতীয় পার্টি এত দিন আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল, এবার সিদ্ধান্তহীন আছে। হাওয়া বুঝে লাঙল চালাবে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকবে, না নতুন মিত্র খুঁজবে—তা এখনই পরিষ্কার করছে না। আর জামায়াতের অবস্থানও রহস্যঘেরা। দলটির নিবন্ধন নেই। বিএনপির জোটে জামায়াত আছে, আবার নেইও। বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্ক নিয়ে গুজব-গুঞ্জন যা-ই থাক, এরা কেউ কাউকে ছাড়বে বলে মনে হয় না।
বিএনপি পুরোনো মিত্রদের শুধু সঙ্গে রাখতে চায় না, সরকার পতনের আন্দোলনে এবং নির্বাচনের পরে ‘জাতীয় সরকার’ গঠনের লক্ষ্যে নতুন মিত্রের সন্ধানেও আছে।
নড়বড়ে অবস্থান হলেও বিএনপির একটি ২০-দলীয় জোট আছে। এই জোটের কেউ কেউ ঘোষণা দিয়ে জোট ছেড়েছে, আবার তাদের একাংশ জোটে আছেও; অর্থাৎ ২০-দলীয় জোটে প্রকৃতপক্ষে কয়টি দল কিংবা দলাংশ আছে, তা গুনে-বেছে বলা খুব সহজ কাজ নয়। এ অবস্থাতেই বৃহত্তর ঐক্যের ডাক দিয়েছে বিএনপি। এ জন্য কিছু ছোট দলের কয়েকজন বড় নেতাকে সঙ্গে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন শুরু করতে চায় দলটি। একই সঙ্গে দল গোছানোর কাজও নাকি শুরু হয়েছে। আগামী তিন মাসে বিভাগীয় পর্যায়ে ১০টি সমাবেশ করার পরিকল্পনা করেছে বিএনপি। এই সমাবেশগুলো সফল করার লক্ষ্যে দেশের আট বিভাগ ও দলের দুই সাংগঠনিক বিভাগের নেতাদের সঙ্গে ধারাবাহিক মতবিনিময় সভা করেছেন বিএনপির নেতারা।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এসব সভা থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের বলা হয়েছে, এখন ক্রান্তিকাল চলছে। এ অবস্থায় দ্বন্দ্ব-বিরোধ ভুলে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা এটা স্বীকার করে নিয়েছেন যে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিরোধ আছে। এটা ভালো লক্ষণ। বালুতে মুখ গুঁজে থাকলে তো আর প্রলয় বন্ধ থাকে না! প্রশ্ন হলো, নেতারা বলবেন আর দলের দ্বন্দ্ব-বিরোধের অবসান হবে, সেটা আশা করা কি ঠিক? বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোতে দ্বন্দ্ব-বিরোধ একটি সাধারণ ঘটনা। একসময় মনে করা হতো, সিপিবিতে নেতৃত্বের বিরোধ তুলনামূলকভাবে কম। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে, সেই সিপিবিতেও দ্বন্দ্ব-বিরোধ কম নয়। এক পক্ষ অন্য পক্ষকে কাবু করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিএনপি নামক দলটি যেহেতু একক নেতৃত্বে পরিচালিত হয় না, সেহেতু কোনো নেতা বললেই দলের ভেতরের মতপার্থক্যের অবসান হবে না। দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে পরিচিত সবারই আছে নিজস্ব সমর্থক গোষ্ঠী। ফলে মাঠপর্যায়ে কোন নেতা কার পরামর্শ অনুযায়ী চলেন, তা বলা মুশকিল। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যা বলেন, সেটাই দলের শেষ কথা—তিনি নিজেও তা জোর দিয়ে বলতে পারবেন কি?
অবশ্য কেউ কেউ এটাও বলতে পারেন যে আওয়ামী লীগের মধ্যে কি এ সমস্যা নেই? অবশ্যই আছে এবং এখন হয়তো বেশি মাত্রায় আছে। ৩ অক্টোবর ঢাকেশ্বরী পূজামণ্ডপে গিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণে প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। কার কত শক্তি আছে, তা দেখানোর প্রতিযোগিতায় নামলে তাঁদের ভবিষ্যতে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না বলেও সতর্ক করে তিনি বলেছেন, ‘আপনাদের শোডাউন দেখতে আমি আসিনি। আমি ঢুকতেই পারছিলাম না। যারা এসব শোডাউন থেকে সংশোধন না হবে, আগামী নির্বাচনে নতুন লোককে মনোনয়ন দেব।...আমি এখানে এসেছি হিন্দুধর্মাবলম্বীদের শারদীয় শুভেচ্ছা জানাতে। কারও লাল গোলাপ শুভেচ্ছা নিতে আসিনি।’
আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের এসিআর যেমন নীতিনির্ধারকদের কাছে আছে, তেমনটা বিএনপির ক্ষেত্রেও আছে বলে ধরে নেওয়া যায়। কিন্তু এই এসিআরের ভয় দেখিয়ে কি কোনো দলের নিজ নিজ কর্মী-সমর্থকদের নিবৃত্ত করা যাচ্ছে? বিএনপির বিভাগওয়ারি মতবিনিময় সভাগুলোতে দ্বন্দ্ব-বিরোধ ভোলার আহ্বান জানানো হলেও কীভাবে তা নিষ্পত্তি হবে, তার কোনো কৌশল কি বের হয়েছে? একটি জেলা কমিটিও কি আছে, যেটাতে বিরোধ নেই? একজন নেতার নেতৃত্ব মেনে চলার বাস্তবতা কোথাও আছে বলে মনে হয় না। কোথাও একটি কমিটির ঘোষণা দিলেই তো ক্ষোভ-অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
এ অবস্থায় ঐকমত্যের ভিত্তিতে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার কথা ভাবছে বিএনপি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, জনগণের দাবি আদায়ে দেশের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে ‘বৃহত্তর ঐক্য’ গড়ে তুলতে বেশ কিছুদিন ধরে সংলাপ চলছে। সংলাপে সব দলই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া ও যুগপৎ আন্দোলনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। যে ১০-১১টি বিষয় সামনে রেখে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো আন্দোলনের কথা ভাবছে, এর মধ্যে আছে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নিঃশর্ত মুক্তি, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ বা অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাস্তবায়ন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ইভিএম বাতিল, আরপিও সংশোধন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, জ্বালানি ও বিদ্যুতের সংকটের সমাধান, শেয়ারবাজার ও ব্যাংকে লুটপাট বন্ধ করা, রাজনৈতিক বন্দীদের মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তি, ডিজিটাল আইনসহ ১৯৭৪ সালের কিছু আইন বাতিল ইত্যাদি।
যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে বিএনপির সঙ্গে যেসব দল সংলাপ করছে, সেগুলোর বেশির ভাগই খুচরা দল হিসেবে পরিচিত। এর সবগুলো দলের প্রধান নেতাও হয়তো জাতীয়ভাবে রাজনীতিতে পরিচিত নন। কোনো কোনো দলে দু-একজন পরিচিত মুখ থাকলেও সক্রিয় নেতা-কর্মী নেই বললেই চলে। দলগুলোর পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটিও হয়তো নেই।
এসব হোন্ডা পার্টি বা খুচরো দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে গিয়ে ভোটের মাঠে বিএনপি কতটা ফায়দা নিতে পারবে, তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। এমনকি শরিক দলের কেউ কেউ বিএনপির এমন উদ্যোগ নিয়ে দ্বিধায় রয়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, অনেক দল আছে, যারা নামসর্বস্ব, জোটে কিংবা রাজনীতির মাঠে তাদের ভূমিকা রাখার কোনো সক্ষমতা নেই।
বিএনপি জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা এলডিপির প্রধান কর্নেল (অব.) অলি আহমদই বলেছেন, বিএনপির জোটে বেশির ভাগ দলই নামসর্বস্ব। কোনো কোনোটা আছে স্বামী-স্ত্রীর দল। তাই এসব দলের সঙ্গে বসলে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা কম। সময় নষ্ট করা হবে। অলি আহমদ বরং জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গে নিয়ে চলার পক্ষে। তাঁর মতে, জামায়াত একটি পুরোনো রাজনৈতিক দল, ভোটের মাঠে তাদের এখনো আবেদন কম নয়। তা ছাড়া, এখনকার যারা জামায়াতে আছে, তাদের মধ্যে তো যুদ্ধাপরাধী নেই। কিন্তু জামায়াতকে সঙ্গে নিলে বিএনপির সঙ্গে ভিড়তে চাইবে না বাম ট্যাগ লাগানো দলাংশগুলো।
বিএনপির বৃহত্তর ঐক্য পরিকল্পনায় বড় সমস্যা হলো নেতা। কার নেতৃত্বে আন্দোলন হবে এবং ভবিষ্যৎ সরকারপ্রধান কে হবেন, সেটা স্পষ্ট না হলে মানুষের মধ্যে আশাবাদ তৈরি হওয়া কঠিন। গত নির্বাচনের আগে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ড. কামাল হোসেনকে প্রধান নেতা নির্বাচন করে তাঁর নেতৃত্বে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপিকে নানা জটিলতা ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল। ক্ষমতায় গেলে কে হবেন সরকারপ্রধান—ভোটের আগে তা স্পষ্ট করতে না পারার ভুল এবার এড়াতে চান বিএনপির নেতারা। তাই এবারের বৃহৎ ঐক্যের প্রধান নেতা নির্বাচনের বিষয়ে বেশ সতর্ক আলোচনা শুরু হয়েছে দলটির ভেতরে। বিষয়টি স্পর্শকাতর হলেও বর্তমান পরিস্থিতিতে তা স্পষ্ট করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম ৩ অক্টোবর বলেছেন, সরকার হটানোর ‘যুগপৎ আন্দোলন’ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই হবে। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের নেতৃত্ব বা নেতা আগেই ঘোষণা করেছি; খালেদা জিয়া আমাদের নেত্রী। তাঁর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের নেতা।’
মির্জা ফখরুল ইসলামের এই ঘোষণার পর খোদ বিএনপিতেই ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে বলে মনে হয় না। বিএনপির সঙ্গে ঐক্যের প্রশ্নে যাঁরা ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছেন, তাঁরাও তারেক রহমানকে যুগপৎ আন্দোলনের নেতা হিসেবে মানতে দ্বিধাগ্রস্ত বলেই বিএনপির মহাসচিব ফলাও করে খালেদা জিয়ার নাম ঘোষণা করেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার নামেও আর ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিস্থিতি আছে কি না, সেটাই এখন বিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন হয়ে ঘুরছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বরং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের একটি বক্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন। জি এম কাদের বলেছেন, রাজনীতিতে ভবিষ্যতে অনেক টানাপোড়েন হবে, অনেক উত্থান-পতন হবে, অনেক ধরনের মেরুকরণ হবে। এগুলো না দেখে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটা সঠিক সিদ্ধান্ত না-ও হতে পারে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা