কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়দের বাড়িতে বেশ সভা-টভা হতো। তিনি আসতেন লীলা মজুমদারদের বাড়ি। একদিন কামাক্ষীদের বাড়িতে এলেন শিল্পী যামিনী রায়, শিল্প সৃষ্টি সম্পর্কে কিছু কথা বলার জন্য। লীলা মজুমদার সেখানে গিয়ে দেখেন, রথী-মহারথীদের অনেকেই সেখানে উপস্থিত। ঘর আলো করে বসে আছেন বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ। লীলাকে বসানো হলো অমিয়বাবুর পাশে। তখনই লীলা মজুমদারের মনে পড়ল বুদ্ধদেব বসুর ‘বৈশাখী’তে সদ্য ছাপা হয়েছে অমিয় চক্রবর্তীর একটা কবিতা।
কবিতাটা বুঝতে পারেননি তিনি। ভাবলেন, অমিয় চক্রবর্তীর কাছ থেকে কবিতার মানেটা জেনে নেবেন। মানে না বুঝলে লীলা মজুমদার কবিতার রস উপভোগ করতে পারেন না।
কবিতাটির গোড়া ছিল এ রকম:
‘বিশুদ্ধ একজন নলিনীচন্দ্র পাকড়াশী,
মাছ বা ল্যাংড়া আম—ইত্যাদি’।
মাথামুণ্ডু না বোঝায় তিনি সরলভাবে অমিয়বাবুকে কবিতার মানে জিজ্ঞেস করলেন।
অমিয় চক্রবর্তী বললেন, ‘কবিতা লিখলে কি তার মানে বলতে হয়ই?’
লীলাও বললেন, ‘লিখলেই বলতে হয় না। কিন্তু ছাপাবার পর কেউ জানতে চাইলে বলতে হয়।’
একটু চুপ করে থাকলেন অমিয় চক্রবর্তী। তারপর উঠে গেলেন। বুদ্ধদেব বসুর কানে কানে কিছু বললেন। তারপর আর তাঁকে সেখানে দেখা গেল না। বুদ্ধদেব বসু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘খুব ভালো কাজ হলো। কবিরা কত স্পর্শকাতর, তা ভুলে গেলে চলবে কেন? উনি বাড়ি চলে গেলেন। বললেন, শরীর ভালো লাগছে না। এখন যামিনীবাবুকে ধন্যবাদজ্ঞাপনের কাজটা কাকে দিয়ে করাই, সেটা বুঝতে পারছি না।’
এর পরের ঘটনাগুলো আর লীলা মজুমদারের মনে নেই। নিশ্চয়ই কাউকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্য পাওয়া গিয়েছিল। সভার আর কেউ এই ক্ষুদ্র নাটিকাটি লক্ষ করেছিলেন কি না, সে বিষয়েও লীলা মজুমদার কিছু জানেন না। তবে পরে তাঁর মনে হয়েছে, অমিয়বাবুর সুন্দর কত কবিতাই না তিনি পড়েছেন আগে। কবির কাছে কবিতার মানে না জানতে চাইলেই হতো বুঝি!
সূত্র: লীলা মজুমদার, পাকদণ্ডী, পৃষ্ঠা ৩১৭-৩১৮