প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুরা, শুভেচ্ছা নিয়ো। আজ তোমাদের বাংলা প্রথম পত্র বিষয়ের প্রবন্ধ ‘বই পড়া’ থেকে ‘অনুধাবনমূলক প্রশ্নোত্তর’ নিয়ে আলোচনা করব।
অনুধাবনমূলক প্রশ্নোত্তর
১. ‘ব্যাধিই সংক্রামক স্বাস্থ্য নয়’– কথাটি প্রাবন্ধিক কেন বলেছেন?
উত্তর: মানুষের শরীর ঠিক জায়গায় থাকে আর তার রোগ আশপাশে বিস্তার লাভ করে। এখানে ব্যাধির সঙ্গে ডেমোক্রেসির দোষের তুলনা করা হয়েছে।
‘ডেমোক্রেসি’ বলতে সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়। ডেমোক্রেসির গুরুরা সবার অধিকার নিশ্চিত করতে অধিকারগত সমতার কথা বলেন। কিন্তু তাদের শিষ্যরা তা ভুল বুঝে প্রত্যেকে বড় হতে চান। এ জন্য সংক্রমিত ব্যাধিকেই দোষারোপ করা হয়েছে, স্বাস্থ্যকে নয়; অর্থাৎ ডেমোক্রেসি এখানে স্বাস্থ্য আর ডেমোক্রেসি সম্পর্কে মানুষের ভুল ধারণা হচ্ছে সংক্রমিত রোগ।
২. সাহিত্যচর্চার সুফল সম্বন্ধে অনেকেই সন্দিহান কেন?
উত্তর: হাতে হাতে পাওয়া যায় না বলে সাহিত্যচর্চার সুফল সম্বন্ধে অনেকেই সন্দিহান।
আমাদের সমাজের অধিকাংশ লোকেরই লোলুপ দৃষ্টি এখন অর্থের প্রতি। অর্থসাধনা না করে সাহিত্যচর্চা করলে আর্থিক কোনো লাভ হবে না বলেই তাদের বিশ্বাস। সাহিত্যচর্চার নগদ কোনো বাজারদর নেই; অর্থাৎ সাহিত্যচর্চা করে কোনো লাভ হলেও সেটা বর্তমানে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ নেই। এ কারণে সাহিত্যচর্চার সুফল সম্বন্ধে অনেকেরই সন্দেহ রয়েছে।
৩. ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’– কথাটির অর্থ ব্যাখ্যা করো।
উত্তর: ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’ কথাটি বলতে আপন চেষ্টায় যে শিক্ষা অর্জন করা যায়, সেটাই প্রকৃত শিক্ষা বোঝানো হয়েছে।
শিক্ষাগ্রহণ কেবল পাঠ্যবইয়ের পড়াশোনা কিংবা পরীক্ষায় পাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতপক্ষে আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শিক্ষাগ্রহণের অসংখ্য উপকরণ। যথার্থরূপে শিক্ষিত হয়ে উঠতে হলে তাই জীবনকে কাছ থেকে দেখতে হবে। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নানা বিষয়ের বই পড়তে হবে। এভাবে যাঁরা সুশিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেন, তাঁদের মাঝেই শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যকে কাজে লাগিয়ে নিজের ও অন্যের জীবনকে সুন্দর করে তোলার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায়। আর এই পদ্ধতিতে নিজে নিজে শিক্ষাগ্রহণের নামই স্বশিক্ষিত হওয়া।
৪. প্রমথ চৌধুরী শিশুসন্তানকে দুধ গেলানোর উদাহরণের মাধ্যমে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তর: শিশুসন্তানকে দুধ গেলানোর উদাহরণ উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রমথ চৌধুরী আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম একটি ত্রুটিকে তুলে ধরেছেন।
দুধ অত্যন্ত পুষ্টিকর খাবার। অনেক মায়েরই ধারণা, সন্তানের পেটে তা যেকোনো উপায়ে পৌঁছালেই সন্তানের উপকার হবে। তাই তাঁরা সন্তানকে জোর-জবরদস্তি করে দুধ গেলানোর চেষ্টা করেন। তাঁরা বুঝতে চান না যে, এভাবে ইচ্ছার বিরুদ্ধে দুধ গেলালে শিশুর উপকারের পরিবর্তে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায়ও অনুরূপভাবে শিক্ষার্থীদের বিদ্যা গেলানোর চেষ্টা করা হয়। ফলে হিতে বিপরীত দশা হয়। শিক্ষার্থীরা স্বশিক্ষিত হওয়ার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
৫. ‘দেহের মৃত্যুর রেজিস্টারি রাখা হয়, আত্মার হয় না’–কথাটির প্রাসঙ্গিকতা বুঝিয়ে লেখো।
উত্তর: ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীদের আত্মিক মৃত্যুর ব্যাপারটি লোকচক্ষুর অন্তরালেই থেকে যায়, এ বিষয়টিই বোঝানো হয়েছে আলোচ্য উক্তিটি দ্বারা।
আমাদের স্কুল-কলেজের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা নিজেদের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ পায় না; বরং তাদের আত্মশক্তি অর্জনের পথ রুদ্ধ হয়। মুখস্থনির্ভর এই শিক্ষাপদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মনের দাবি মেটে না। ফলে আত্মার অপমৃত্যু ঘটে। দেহের মৃত্যুর হিসাব রাখা হলেও মানুষের আত্মার মৃত্যুর কোনো হিসাব কেউ রাখে না। ফলে শিক্ষার্থীদের এ ক্ষতির বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অজ্ঞই থেকে যাই।
৬. ‘স্কুল-কলেজের শিক্ষা অনেক স্থলে মারাত্মক’– প্রমথ চৌধুরীর এমন মন্তব্যের কারণ কী?
উত্তর: স্বশিক্ষিত হওয়ার পথে স্কুল-কলেজের শিক্ষা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বলে প্রমথ চৌধুরী এই শিক্ষাকে মারাত্মক বলে অভিহিত করেছেন।
‘বই পড়া’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় নানা ধরনের ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। শিক্ষার্থীদের এখানে শিক্ষা লাভের জন্য ব্যক্তিগত সাধনার প্রয়োজন হয় না; বরং গুরুরাই কষ্ট স্বীকার করে শিক্ষার্থীকে জোর করে বিদ্যা গেলান। গুরুদের দেওয়া নোট পড়ে শিক্ষার্থীরা কেবল পাস করে, যথার্থ শিক্ষিত হয় না। স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ কেড়ে নেয় বলে স্কুল-কলেজের শিক্ষা সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করেছেন প্রমথ চৌধুরী।
৭. প্রমথ চৌধুরী লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপর স্থান দিয়েছেন কেন?
উত্তর: লাইব্রেরিতে মানুষ স্বেচ্ছায় স্বশিক্ষিত হতে পারে বলে প্রমথ চৌধুরী লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপর স্থান দিয়েছেন।
স্কুল-কলেজে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে, ‘বই পড়া’ প্রবন্ধে প্রমথ চৌধুরী তাকে ত্রুটিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। পরীক্ষায় ভালো ফলাফল লাভ করানোর জন্য শিক্ষার্থীকে এখানে জোর করে বিদ্যা গেলানো হয়। ফলে শিক্ষার্থীর প্রাণশক্তি বলতে তেমন কিছুই গড়ে ওঠে না। অন্যদিকে লাইব্রেরিতে স্বাধীনভাবে স্বশিক্ষিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া যায়, যা সুশিক্ষিত হওয়ার প্রধান উপায়। এ কারণেই প্রমথ চৌধুরী লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের ওপর স্থান দিয়েছেন।
৮. আমাদের দেশে বেশি বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন কেন?
উত্তর: লাইব্রেরিতে সাহিত্যচর্চা করে মানুষ যথার্থ শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারে বলে আমাদের দেশে বেশি বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
লাইব্রেরিতে মানুষ স্বচ্ছন্দচিত্তে সাহিত্যচর্চার সুযোগ পায়। এর ফলে মানুষ স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠে। আর সুশিক্ষিত মানুষ মাত্রই স্বশিক্ষিত। দেশে যত বেশি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হবে যথার্থ প্রাণশক্তিসম্পন্ন একটি জাতি গড়ার সম্ভাবনাও তত বেশি বাড়বে।
৯. স্বেচ্ছায় বই পড়ার ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরী গুরুত্ব দিয়েছেন কেন?
উত্তর: স্বেচ্ছায় বই পড়লে সুশিক্ষিত হয়ে ওঠা যায় বলে প্রমথ চৌধুরী এ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।
আমাদের প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় জোর করে পাঠ্যবইয়ের
বিদ্যা গেলানোর অপচেষ্টা চালানো হয়। এমন পরিবেশে যথার্থ শিক্ষিত মানুষ হয়ে ওঠা সম্ভব নয় বলে প্রমথ চৌধুরীর মতামত। তাঁর মতে, একটি আত্মনির্ভরশীল জাতি গঠন করতে হলে স্বেচ্ছায় সাহিত্যচর্চার প্রতি মনোযোগী হতে হবে। যে জিনিস করে আনন্দ পাওয়া যায় না, তা থেকে ভালো কোনো ফলাফল আশা করাও বৃথা। তাই সবাই সানন্দে বই পড়ে সাহিত্যচর্চার সুফল লাভ করবে, এই প্রত্যাশা প্রমথ চৌধুরীর।
আতাউর রহমান সায়েম, সিনিয়র সহকারী শিক্ষক আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মতিঝিল, ঢাকা।