হোম > ছাপা সংস্করণ

পদ্মা সেতু: দূরদৃষ্টি-সাহস-সংকল্পের বাস্তব রূপ

বিভুরঞ্জন সরকার

পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক হয়ে এই সেতু এখন সবার সামনেই দৃশ্যমান। দেশপ্রেমিক প্রতিটি বাঙালি এখন অহংকার করে বলতে পারে, বাংলাদেশ আর কারও দয়া বা করুণার মুখাপেক্ষী নয়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরনির্ভরতার বৃত্ত ভাঙার সাহস দেখিয়ে গোটা জাতিকে এই প্রত্যয়ে জাগিয়ে তুলেছেন যে, দেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ শক্তি কোনো ঔদ্ধত্যের কাছে মাথা নত করে না। বাঙালি কারও অন্যায্য চাপের কাছে অসহায়ের মতো আত্মসমর্পণ করে না। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করে আর এবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পদ্মা সেতু নির্মাণের যুদ্ধে জয়ী হয়ে আবার প্রমাণিত হয়েছে যে ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’। শেখ হাসিনা বরাবরের মতোই এবারও দেখিয়েছেন, কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হওয়ার যোগ্যতা আছে তাঁরই।

অথচ আজ থেকে ১০ বছর আগে এই সেতু নির্মাণের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে দুর্নীতির অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক এতে অর্থায়ন থেকে যখন পিছিয়ে যায় এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন নিজস্ব অর্থায়নে সেতুটি নির্মাণের ঘোষণা দেন, তখন বিএনপিসহ আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক দল ছাড়াও কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ, স্বাধীন চিন্তক বলে পরিচিত কোনো কোনো ব্যক্তি তাচ্ছিল্যের ঢঙে বাঁকা মন্তব্য করেছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যকে ‘হাস্যকর এবং অবাস্তব’ বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।

পদ্মা সেতু নির্মাণযজ্ঞ সফলভাবে শেষ হওয়ার পর এখন কার বা কাদের বক্তব্য হাস্যকর ও অবাস্তব বলে মনে হচ্ছে? এই হলো আমাদের একশ্রেণির বাক্যবাগীশ বুদ্ধিজীবীর দূরদর্শিতা।

দাতাগোষ্ঠীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রভাবিত করেছিলেন আমাদের দেশেরই মানুষ, তাঁদের দু-একজন আবার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন। আর বিএনপি নামের দলটির তো আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে বলার জন্যই যেন গঠিত হয়েছে! যাঁর নেতৃত্বে দলটি পরিচালিত হয় অবান্তর কথা বলায় তাঁর জুড়ি নেই। পার্বত্য চুক্তি হলে ফেনী পর্যন্ত ভারতের দখলে চলে যাবে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে—এমন সব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বাণী তো বিএনপিপ্রধানেরই মুখনিঃসৃত। নয় কি?

সব বাধা ডিঙিয়ে শেখ হাসিনার সাহস ও সংকল্পের দৃঢ়তায় পদ্মা সেতুর কাজ যখন শুরু হলো, তখন বিএনপির চেয়ারপারসন ও একাধিক বারের প্রধানমন্ত্রী বললেন, জোড়াতালি দিয়ে পদ্মা সেতু বানানো হচ্ছে। এতে পারাপার হতে গেলে এটা ভেঙে পড়বে। ভাবুন, আমাদের একজন অন্যতম জাতীয় নেত্রীর প্রকৌশল ও কারিগরি জ্ঞান কতটা গভীর ও বিস্তৃত! ভাগ্যিস এখনো এটা বলা হয়নি যে এই সেতু তৈরিতে গলদের বড় প্রমাণ, এটা একটা বাঁকাত্যাড়া সেতু!

পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত বিশেষজ্ঞ সদস্য, প্রয়াত প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী এই সেতু নির্মাণকাজের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন: এই সেতুর প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে পদ্মা-যমুনার মিলিত প্রবাহ। প্রতি সেকেন্ডে মাওয়া পয়েন্টে ১ লাখ ৪০ হাজার ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। এমন হিসাব মিলছে ১০০ বছরের তথ্য থেকে। আমাজন নদীর পরেই কোনো নদী দিয়ে এত পানি প্রবাহিত হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে প্রবাহিত হয় প্রতি সেকেন্ডে ৯০ হাজার ঘনমিটার পানি। ফলে পদ্মা সেতুর ডিজাইন করতে গিয়ে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়েছে—এখন যে নদীর তলদেশ, আগামী ১০০ বছর পর তেমনটি কি থাকবে? অর্থাৎ যদি তলদেশের মাটি উধাও হয়ে যায়? সমীক্ষায় দেখা গেছে আগামী ১০০ বছরে নদীর তলদেশের ৬২ মিটার পর্যন্ত মাটি সরে যেতে পারে। এই ‘৬২ মিটার’ বিবেচনায় নিয়ে ডিজাইন করতে হয়েছে। আমরা নিশ্চিত নই মাটির স্তর থাকবে কি থাকবে না? সেতুর খুঁটি এমন গভীরতায় নিতে হবে, যাতে সেতু এবং তার ওপর দিয়ে চলা গাড়ির চাপ নিতে পারে। প্রবল ভূমিকম্প হলেও যেন সেতুটি বসে না যায়। যমুনায় ৬৫ মিটার নিচে একটি পাথরের লেয়ার পাওয়া গেছে। কিন্তু পদ্মায় যে আরও অতল। এখানে ৬২ মিটার ঝুঁকিপূর্ণ। তাই পাইল ১২০ মিটার পর্যন্ত হবে। যেকোনো সেতুর জন্য এটি এ পর্যন্ত গভীরতম পাইল। (অজয় দাশগুপ্ত, জামিলুর রেজা চৌধুরীর ভাষ্যে পদ্মা সেতুর সাতকাহন, সমকাল, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫)

পদ্মা সেতু তৈরি যখন কোনো উপায়েই ঠেকানো গেল না, শকুনের দোয়ায় যখন গরু মরল না, তখন সামনে আনা হলো নতুন অভিযোগ। কী? ১০ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পের ব্যয় ৩০ হাজার কোটি টাকায় বাড়িয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ব্যাপক দুর্নীতি করেছে। এই জ্ঞানপাপীরা আসলে মিথ্যাচারে এবং মনগড়া কথা বলতে অভ্যস্ত। না হলে পদ্মা সেতুতে ব্যয় বৃদ্ধি সম্পর্কে প্রফেসর জামিলুর রেজা চৌধুরী কী বলেছিলেন, তা একবার তারা দেখে নিতে পারত। জামিলুর রেজা চৌধুরী নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ সরকারের শিখিয়ে দেওয়া বুলি তোতা পাখির মতো উগড়ে দেননি? বিএনপি কি জামিলুর রেজা চৌধুরীকেও আওয়ামী লীগের ধামাধরা মনে করতে পারে, কারণ যাঁর বক্তব্যই দেশের বৃহত্তর স্বার্থানুকূল হবে, তাঁর নামই বিএনপি শত্রুর তালিকায় রাখে।

জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেছিলেন, বিশ্বব্যাংক-এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-জাইকা যখন পদ্মা সেতুতে যুক্ত ছিল, তখন ঠিক হয়েছিল কাস্টমস শুল্ক ও ভ্যাট পরিশোধ করবে সরকার। এই হিসাব থাকত কাগজে-কলমে। সে কারণে ব্যয় কিছুটা কম দেখা গেছে। এখন তা দেবে ঠিকাদার। তবে তারা এ অর্থ তো আমাদের সরকারের কাছ থেকে নেবে। প্রকৃতপক্ষে আগের সঙ্গে বর্তমান ব্যয়ের তেমন পার্থক্য নেই। কিছু ব্যয় মূল্যস্ফীতির কারণে বেড়েছে। (সমকাল, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫)

তা ছাড়া, নদীশাসনের অনেক ধরনের সরঞ্জাম কিনতে হয়েছে জার্মানি এবং অন্যান্য দেশ থেকে। বিদেশি কনসালট্যান্টদের বেতন-ভাতা দিতে হয় ডলার-ইয়েন-পাউন্ডে। পদ্মা সেতুর ব্যয় যখন প্রথমে প্রাক্কলন করা হয়েছিল, তখন ডলারের মূল্য ৬৮-৬৯ টাকার মতো ছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে যখন ব্যয় করা হয়, তখন প্রতি ডলার পেতে ব্যয় করতে হয়েছে ৮৪.৮০ টাকা; অর্থাৎ প্রতি ডলার কিনতে ২৪-২৫ শতাংশ বেশি ব্যয় করতে হয়েছে। ফলে সংগত কারণেই প্রাক্কলিত ব্যয়ের বেশি ব্যয় হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে।

কিন্তু বিএনপি এবং আওয়ামী লীগবিরোধীরা এসব শুনবে কেন? এগুলো তো যুক্তি-বুদ্ধির কথা। যুক্তির জোর বিএনপির নেই, দলটি জোরের যুক্তি পছন্দ করে।

এ প্রসঙ্গে গত শতকের ষাটের দশকে প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। দক্ষিণ ভারতের একটি রাজ্যে একটি অতিপ্রয়োজনীয় বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন নেহরু। কিন্তু বাঁধের কাজ শুরুর কয়েক বছর পর দেখা গেল, বাঁধ নির্মাণের যে ব্যয় প্রথমে ধরা হয়েছিল, কাজ শেষ করতে গিয়ে ব্যয় তার চেয়ে অনেক বেশি হয়েছে। বাঁধ উদ্বোধনের দিন একজন সাংবাদিক নেহরুকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করায় নেহরু একটু বিরক্ত হয়ে জবাব দিয়েছিলেন, ‘ব্যয় বেশি হয়েছে তো কী হয়েছে? বাঁধ তো হয়েছে। আমাদের কাছে তো বাঁধটি খুবই জরুরি ছিল! (বাজেট বহুত জেয়াদা হুয়া, তো ক্যায়া হুয়া, ড্যাম তো হুয়া! দেটস হোয়াট উই নিডেড ব্যাডলি!)’

পদ্মা সেতুর ব্যয় বাড়লেও সেতুটি তো হলো। দেশের ২১টি জেলার ৩ কোটি মানুষ যে সেতুর সরাসরি উপকারভোগী হবে, সে সেতু কি আমাদের জন্য জরুরি ছিল না? এটা স্বীকার করতেই হবে যে পদ্মা সেতু বাঙালির গর্বের সম্পদ। অহংকারের ধন। এ সেতু দিয়ে চলাচলের জন্য কোটি কোটি মানুষ অধীর আগ্রহে উদগ্রীব হয়ে আছে। এই সেতুর সঙ্গে দেশের সব মানুষের আবেগ ও অহংকারের বিষয়টি জড়িত। কিন্তু সরকারবিরোধীরা, সমালোচকেরা মানুষের আবেগের মর্যাদা দিচ্ছেন না। বিদ্যুতের বদলে খাম্বা দিয়ে যারা মানুষকে সান্ত্বনা দিয়েছে, তাদের মিথ্যা, মনগড়া নেতিবাচক প্রচারণা সেতু নির্মাণ যেমন ঠেকাতে পারেনি, তেমনি মানুষের উচ্ছ্বাসকেও দাবিয়ে রাখা যায়নি, সেতু উদ্বোধনের দিন কি তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি?

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ