প্রাণীমাত্রই সন্তান লালনপালন করে প্রকৃতির কাছে সমর্পণ করে। শুধু মানুষই সন্তান লালনপালন শেষে সন্তানের কাছে প্রত্যাশা করে। সেই প্রত্যাশা হলো—সন্তান পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে কল্যাণকর ভূমিকা পালন করবে। সন্তানের সাফল্য ব্যক্তিকে সম্মান-মর্যাদায় আসীন করে।
বেশির ভাগ প্রবীণ প্রত্যাশা করেন, শেষ বয়সে সন্তানের সান্নিধ্যে, সেবাযত্নে জীবন কাটাতে। নানা কারণে অনেকেরই সেই প্রত্যাশা পূরণ হয় না। তৈরি হয় হতাশা, বিষণ্নতা, নিঃসঙ্গতা আর অভিযোগ, নালিশ করার প্রবণতা।
সন্তানের সাফল্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের ভূমিকাকে প্রধান করে দেখতে চায়। সন্তান যত বেশি অর্থবিত্তে, ক্ষমতায়, শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যায়; ব্যক্তি তত বেশি আত্মতুষ্টিতে ভোগে। ভুলতে বসে, বড় হওয়ার ক্ষেত্রে পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রের ভূমিকার কথা।
সমাজের সম্পদ, অভিজ্ঞতা, দক্ষতা, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা থেকে পুষ্টি গ্রহণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার প্রেরণা লাভ করে। সমাজের অবদানকে উপেক্ষা করে ব্যক্তির সহায়সম্পদের তীব্র আকাঙ্ক্ষা সমাজে ক্ষতের সৃষ্টি করে। কোনো মানুষের পক্ষেই সমাজের ভূমিকা উপেক্ষা করে বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। অথচ ব্যক্তি সমাজের ঋণ পরিশোধ করে সমাজকে আরও বেশি সমৃদ্ধ করার প্রেরণা লাভ করতে আগ্রহী হতে চায় না। ব্যক্তি প্রতিষ্ঠার প্রেরণা মানুষকে সমাজবিচ্ছিন্ন হতে সহায়তা করে। কাউকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়—এটা কমবেশি সবাই বুঝতে পারে। তবু পেছনে ফেলার প্রবণতা কমছে না।
ব্যক্তির সম্পদ অর্জনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো—ব্যক্তি নিজে, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনিরা বংশানুক্রমিকভাবে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে পারবে।
ব্যক্তি নিজে প্রবীণ জীবনে প্রবেশ করে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। প্রবীণ শারীরিক, সামাজিক, আবেগীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদা পূরণ করতে সচেষ্ট হন।
শারীরিক চাহিদাগুলো হলো ভাত, কাপড়, আশ্রয় ও চিকিৎসা। এগুলো পূরণে ব্যক্তি নিজে বা সন্তানেরা ভূমিকা পালন করে। বাকি চাহিদা পূরণ করতে খুব কম মানুষই পারে।
দীর্ঘ সময় ধরে আমরা মনে করেছি, প্রবীণের দেখভাল, সেবাযত্ন সন্তান করবে। একসময় গড় আয়ু কম থাকায় প্রবীণের সংখ্যা কম ছিল। যৌথ পরিবারের সম্মিলিত সহযোগিতায় প্রবীণ জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল।
বর্তমানে দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে কাজ করছে। গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন কলকারখানায় কোটিখানেক শ্রমিক কাজ করেন, যাঁদের পরিবার-পরিজন গ্রামে থাকেন। সামর্থ্যবান পরিবারের ছেলেমেয়েরা উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যায়। বেশির ভাগই আর দেশে ফিরে আসে না। যেসব ছেলে-মেয়ে পরিবারের সঙ্গে থাকে, তারাও চাকরিবাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ক্যারিয়ার নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। কৃষিকাজে নিয়োজিত বিপুলসংখ্যক মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রমে কর্মক্লান্ত।
ঠিক এমন একটা পরিস্থিতিতে প্রবীণের সেবাযত্ন, দেখভালের দায়িত্ব সন্তানের ওপর দেওয়া কতখানি যৌক্তিক এবং ন্যায়সংগত, তা ভাবনার সময় এসেছে।
যে মানুষটি আজ প্রবীণ হয়েছেন, তিনি একসময় নবীন ছিলেন। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে যথাসাধ্য ভূমিকা রেখেছেন। আজ প্রবীণ জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে শুধু সন্তানের সহায়তা যথেষ্ট নয়। সন্তানকে শাস্তির ভয় দেখিয়ে সংকট মোকাবিলা করা অনেক কঠিন। ফলে আজ যাঁরা তরুণ, কর্মক্ষেত্রে আছেন; তাঁদের স্বস্তিদায়ক কর্মক্ষম প্রবীণ জীবনের জন্য কাজ করতে হবে। গ্রামগঞ্জে, শহর-বন্দরে প্রবীণ সেবার সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে প্রবীণজীবনকে সহজতর করতে হবে।
সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রবীণের তালিকা তৈরি করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবার ব্যবস্থা করবে। সক্ষম প্রবীণেরা সামাজিক সেবাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে নেতৃত্বের ভূমিকায় থাকলে সবচেয়ে বেশি ভালো হতো; কিন্তু প্রবীণদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর। তাঁদের জন্য অনেক ভালো ভালো উদ্যোগ সফলতা অর্জন করতে পারে না।
অনেকেই মনে করেন, বৃদ্ধাশ্রম, প্রবীণ নিবাস, প্রবীণ হোস্টেল নির্মাণ করে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করলে প্রবীণেরা সুখী হবেন, শান্তিতে থাকবেন। কথাটা আংশিক সত্য।
প্রবীণদের শারীরিক চাহিদা পূরণ করাই যথেষ্ট নয়; তাঁর আবেগীয়, সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক, স্রষ্টাকেন্দ্রিক চাহিদা রয়েছে।
এসব চাহিদা পূরণ না হলে প্রবীণ সংকটে পড়বেন। একজন প্রবীণ ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য আশা করেন। সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে চান। কথা বলতে চান। অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে নতুন নতুন চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত হতে চান। সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করেন।
মনে রাখতে হবে, মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক সব কর্মকাণ্ডে যুক্ত থেকে প্রবীণজীবন কাটাতে চান। জীবনকে রাঙাতে চান। জীবনকে পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করতে চান। এগুলো সুযোগ নয়, অধিকার।
অনেক যোগ্যতা-দক্ষতাসম্পন্ন প্রবীণ রয়েছেন, যাঁরা শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ স্বাভাবিক। তাঁদের উপযুক্ত কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দিতে হবে। ধর্মীয় কাজকর্মে অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রবীণ পারলৌকিক শান্তির আশা করেন। উক্ত চাহিদাগুলো পূরণে সন্তানের ওপর ভরসা রাখলে চলবে না। গড়ে তুলতে হবে অলাভজনক সামাজিক প্রতিষ্ঠান। যেখান থেকে প্রবীণেরা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবাকর্মীর সেবা পাবেন। চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া এবং সার্বক্ষণিক সেবার জন্য লোক পাবেন। নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তির জন্য কথা বলার লোক পাবেন। গান-বাজনা, সিনেমা হলে, নাটকে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাওয়ার সঙ্গী পাবেন। পছন্দের জায়গায় বেড়ানোর সুযোগ পাবেন। হাটবাজারে কেনাকাটায় দক্ষ সঙ্গী পাবেন।
এসব সেবা পেতে অবশ্যই টাকা খরচ করতে হবে। যাঁরা সামর্থ্যবান, তাঁরা সেবা কিনে নেবেন। যাঁদের সেবামূল্য পরিশোধ করার সামর্থ্য নেই, তাঁদের সেবামূল্য স্থানীয় সরকার অথবা সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো পরিশোধ করবে।
আমাদের সন্তাননির্ভর প্রবীণজীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টানোর সময় এসে গেছে। প্রবীণজীবন হবে সমাজনির্ভর। প্রবীণের সামাজিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে, শক্তিশালী করে প্রবীণ জীবনকে অর্থবহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ করা সম্ভব।