হোম > ছাপা সংস্করণ

রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের ইতিবৃত্ত ও করণীয়

অরুণাভ পোদ্দার

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন কয়েক সপ্তাহ ধরেই দিনক্ষণ দিয়ে বলছিলেন রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের কথা। কিন্তু ভ্লাদিমির পুতিন সরাসরি ইউক্রেন আক্রমণ না করে প্রথমে ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি দিয়ে সেই অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি করে সেখানে রুশ সৈন্য পাঠিয়ে পশ্চিমের হিসাব-নিকাশ উল্টে দিলেন।

গত বৃহস্পতিবার ভোরে রাশিয়া তিন দিক থেকে স্থলে-জলে-অন্তরিক্ষে ইউক্রেনকে আক্রমণ করেছে। শুক্রবার পর্যন্ত ইউক্রেনের ১২০ অধিক সামরিক স্থাপনা দখল করেছে রাশিয়ান সেনারা। তারা কিয়েভের উপকণ্ঠে পৌঁছে গেছে প্রায় বিনা বাধায়। আমি রাশিয়ার এই পদক্ষেপের নিন্দা জানানোর আগে প্রথমেই প্রশ্ন রাখি, রাশিয়া ইউক্রেন ইস্যুতে কেন এত স্পর্শকাতর প্রতিক্রিয়া দেখাল? এর উত্তরের মাঝেই লুকিয়ে আছে বর্তমান সমস্যার কারণ ও সমাধান।

প্রথমেই বলে রাখি, পৃথিবীকে আমরা যত গণতান্ত্রিক, মানবিক বলি না কেন, আসলে তা না। উন্নত দেশগুলো মুখে মুখে মানবাধিকার, গণতন্ত্রের কথা বললেও আসলে তাদের কাজকর্মে তা পরিলক্ষিত হয় না। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সারা বিশ্ব ভেবেছিল স্নায়ুযুদ্ধের শেষে এবার বিশ্ব সত্যিকারের উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, স্বাস্থ্য ও পরিবেশের প্রতি এই সবুজ গ্রহের অধিবাসীদের নজর দেওয়ার সুযোগ এসেছিল। তখন একটা কথা খুবই শোনা যেত—আমরা সবাই ‘গ্লোবাল ভিলেজ’-এর অংশ। খুবই যুক্তিযুক্ত কথা। আমরা যারা প্রগতির পক্ষে, মানুষের জীবনমান উন্নয়নের পক্ষে, মানবাধিকারের পক্ষে কথা বলি, তারা খুবই আশান্বিত হয়েছিলাম; বরং সোভিয়েত লৌহ জমানার পতনে যারপরনাই খুশিও হয়েছিল অনেকে। কিন্তু সেই মধুচন্দ্রিমা থাকেনি বেশি দিন। কেন থাকেনি তা-ই বলছি এখন।

নব্বইয়ের দশকের প্রথমার্ধে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রসচিব জেমস বেকার সোভিয়েত নেতা গর্ভাচেভকে কথা দিয়েছিলেন বার্লিন প্রাচীর পতনের শর্তে ন্যাটো আর এক ইঞ্চিও সম্প্রসারিত হবে না। ২০৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতনের পর ওয়ারশ জোটের বিলোপ সাধিত হয় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। বিশ্ব আশা করেছিল ন্যাটোও হয়তো বিলুপ্ত হতে চলেছে। কিন্তু আমেরিকা তার কথা রাখেনি; বরং প্রিবাল্টিকের তিনটি দেশ লাটভিয়া, লিথুনিয়া, এস্টোনিয়াকে প্রথমেই ন্যাটো জোটভুক্ত করা হয়। ওয়ারশ জোটের মূল প্রাণকেন্দ্র পোল্যান্ডসহ হাঙ্গেরি, রোমানিয়া, চেক, স্লোভাকিয়া, স্লোভেনিয়াকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত করে তা আরও পূর্ব দিকে সম্প্রসারিত করা হয়। এই সবকিছুই করা হয়েছিল রাশিয়া জুজুর মুলা ইউরোপীয়দের সামনে ঝুলিয়ে। এর মাঝে ১৯৯০ সালে সাদ্দাম হোসেনের কুয়েত দখলকে কেন্দ্র করে মার্কিনরা একদফা একতরফা ক্ষমতা প্রদর্শন করে। শোনা যায়, সাদ্দাম হোসেনকে গোপনে আমেরিকাই প্ররোচিত করেছিল কুয়েত আক্রমণের জন্য। সিনিয়র বুশ সেই সুযোগে কুয়েত মুক্ত করে নিজেকে বিশ্বের সামনে মুক্তির দূত হিসেবে তুলে ধরেন। সেই সুযোগে সৌদি আরবসহ কুয়েত, কাতার, ওমানে মার্কিন ঘাঁটি গড়ে তোলেন। তখন বিশ্বে এককেন্দ্রিক (ইউনি পোলার) বিশ্বব্যবস্থা থাকায় আর সোভিয়েত পতন ও চীনের অর্থনীতি ততটা মজবুত না থাকায় তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। এদিকে বদ্ধ মাতাল ইয়েলৎসিনকে শিখণ্ডী দাঁড়া করিয়ে একে একে পূর্ব ইউরোপসহ সাবেক সোভিয়েত রিপাবলিকগুলোতে প্রো-আমেরিকান সরকার গঠন ও ন্যাটো ব্লকে চালিয়ে যাচ্ছিল পশ্চিম। এর মাঝে ১৯৯৯ সালে রাশিয়ার পটপরিবর্তন হয়। ক্ষমতাসীন হন বর্তমান প্রেসিডেন্ট, সাবেক কেজিবি গুপ্তচর ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি প্রথমেই রাশিয়ার জরাজীর্ণ অর্থনীতির পুনর্নির্মাণে মনোনিবেশ করেন। এর মাঝে বিশ্বে ঘটে যায় ৯/১১-এর মতো সন্ত্রাসী ঘটনা। আল-কায়েদা ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার, ওয়াশিংটন ডিসির পেন্টাগনসহ বেশ কয়েক জায়গায় সরাসরি হামলা চালিয়ে আমেরিকাসহ সারা বিশ্বকে চমকে দেয়। শুরু হয় আমেরিকা তথা জুনিয়র বুশের নেতৃত্বে সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ। আফগানিস্তানে কোনো প্রমাণ ছাড়াই আক্রমণ, বি-৫২ থেকে বোমা মেরে আল-কায়েদা দমনের নামে আফগানিস্তানকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার কথা আমরা সবাই জানি। কিন্তু এত কিছুর পরও আল-কায়েদাপ্রধান আর ধরা পড়েন না। তিনি নিহত হন আমেরিকার কমান্ডো হামলায় ২০১১ সালে, খোদ পাকিস্তানের ইসলামাবাদের কাছে। সেই কাহিনি সবার জানা।

এর পরই মার্কিন আর ব্রিটিশরা সাদ্দামকে উৎখাতের কৌশল খুঁজতে থাকে। প্রথমে টুইন টাওয়ার হামলায় জড়ানোর চেষ্টা করলেও তা হালে পানি পায়নি। এরপর জুনিয়র বুশ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মিলে ইরাকে ‘ম্যাস ডেসট্রাক্টিভ উইপেন’ বা প্রাণঘাতী অস্ত্রের ধোয়া তুলে সরাসরি ইরাক আক্রমণ করেন এবং ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত ও সাদ্দামকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েও কোনো প্রাণঘাতী অস্ত্রের খোঁজ পায়নি। এরপর শুরু হয় আমেরিকার নেতৃত্বে আরব বসন্ত ও গণতন্ত্রের নামে আরেক খেলা। রাশিয়া, চীনের নীরব ভূমিকা আমেরিকা ও ব্রিটেনকে ক্ষমতায় মদমত্ত করে তোলে। যা খুশি তাই করার লাইসেন্স পেয়ে লিবিয়া, সিরিয়ায় হামলা করে। এসব দেশে কখনো বিদ্রোহীদের সাহায্যের নামে, কোথাও আল-কায়েদা, আইএসআই দমনের নামে নিজের সৈন্য নামিয়ে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে। উদ্বাস্তু হয় লাখো কোটি মানুষ। তার ঢেউ পৌঁছে পশ্চিম ইউরোপেও। এক জার্মানিই কয়েক লাখ সিরীয়, আফগান শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। কিন্তু সিরিয়ায় আসাদ সরকারকে উৎখাত করতে গিয়ে ২০ বছরের মধ্যে প্রথম আমেরিকা তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। সিরিয়ার লাটাকিয়ার বিমানঘাঁটি রক্ষার্থে প্রথমে রুশ বাহিনী সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করে ২০১৩ সালে। কৃষ্ণসাগর ও ভূমধ্যসাগরে রুশ নৌ-উপস্থিতি ও লাটাকিয়া থেকে বিমান আক্রমণ আমেরিকান মদদপ্রাপ্ত আসাদবিরোধী বিদ্রোহী, আইএসআই ও তুরস্কের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়। এককথায় বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনের পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

এর মধ্যে একসময় ক্রুশ্চেভের কাছ থেকে উপহার পাওয়া ক্রিমিয়ার জনগণও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। সেই গণভোটে রুশপন্থীরা জয়লাভ করে। রাশিয়া সরাসরি সৈন্য পাঠিয়ে ক্রিমিয়া তাদের দখলে নেয়। এর পরই শুরু হয় রাশিয়ার ওপর আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমের অবরোধ। প্রথমে রাশিয়ার অর্থনীতি বেশ ধাক্কা খেলেও সামলে ওঠে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য থেকে শুরু করে যন্ত্রাংশ, সফটওয়্যার—সবকিছুতেই স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে ওঠে। আর অস্ত্র ও জ্বালানি রপ্তানি করে নিজেদের অর্থনীতি সংহত করে। ভ্লাদিমির পুতিনও আমেরিকার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে থাকেন; বিশেষ করে তাঁর নিজ উঠানে ন্যাটোর সম্প্রসারণে তীব্র আপত্তি তোলেন। এদিকে পশ্চিমের প্রত্যক্ষ মদদে তথাকথিত ‘অরেঞ্জ বিপ্লবের’ মাধ্যমে রুশপন্থী সরকারকে উৎখাত করে, একেবারে উগ্র দক্ষিণপন্থীরা ক্ষমতায় আসে। ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগদানের জন্য উদ্গ্রীব হয়ে ওঠে। এদিকে রাশিয়া তার নিজ ঘাড়ে ন্যাটোকে নিশ্বাস ফেলতে দিতে নারাজ। ইতিমধ্যে পূর্ব ইউক্রেনের দানেস্তক ও লুহান্সের রুশ ভাষাভাষী জনগণের ওপর নেমে আসে উগ্র জাতীয়তাবাদী ইউক্রেনিয়ার নির্যাতন। রাশিয়ার সহায়তায় তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই হচ্ছে সংক্ষেপে রাশিয়া আর ইউক্রেন সংকটের মূল।

এখন ভেবে দেখার বিষয়, স্নায়ুযুদ্ধের সময় গড়ে ওঠা ন্যাটো-ওয়ারশ জোটের মধ্যে যখন একটি (ওয়ারশ) বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তখন ন্যাটোর পূর্বমুখী সম্প্রসারণ কতটুকু যুক্তিযুক্ত। যেখানে রাশিয়া বারবার বলছে তারা ঘাড়ের ওপর ন্যাটোর নিশ্বাস ফেলতে দেবে না।

ধরুন, আমেরিকার চৌহদ্দি মেক্সিকো বা কিউবা বা সেন্ট্রাল আমেরিকায় যদি কেউ পারমাণবিক মিসাইল বসায়, তবে তা কি আমেরিকা মেনে নেবে? আমরা সবাই কী ভুলে গেছি ষাটের দশকের কিউবার সোভিয়েত মিসাইল বসানোর ইতিহাস? তা হলে সে ক্ষেত্রে রাশিয়া তার নিরাপত্তার কথা বললে কেন পশ্চিমের গাত্রদাহ হয়? ইউক্রেনকে উসকে দিয়ে পশ্চিম এখন তামাশা দেখছে। অনেকটা গাছে তুলে মই কাড়া।

এই সংকট ও যুদ্ধ থেকে বের হওয়ার একমাত্র উপায় এখনো আছে। তা হলো ইউক্রেনকে ঘোষণা দিতে হবে নিরপেক্ষ বাফার স্টেট হিসেবে থাকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ভূমিকা রেখেছিল সুইজারল্যান্ড ও ফিনল্যান্ড। তারা কোনো পক্ষেই না থেকে নিরপেক্ষ ছিল। রাশিয়ারও উচিত তার প্রতিবেশীদের কাছে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তোলা, বিশ্বাস অর্জন করা। না হলে আমেরিকা তার প্রতিবেশীদের বোঝাতে সক্ষম হবে, ন্যাটো ছাড়া তোমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই। সেই ফাঁদে রাশিয়া ইতিমধ্যেই পা দিয়েছে।

মনে রাখতে হবে, বর্তমানের পারমাণবিক অস্ত্রের যুগে যুদ্ধ ভয়ানক পরিণতি নিয়ে আসতে পারে। এই যুদ্ধে প্রকৃতভাবে কেউই জয়লাভ করতে পারবে না। দুই দেশের জনগণকেই যুদ্ধের মাশুল টানতে হবে। যেখানে বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধা, দারিদ্র্য, করোনা মহামারিতে জর্জরিত, সেখানে এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ সাধারণ মানুষের দুর্দশাই বাড়াবে। আর পশ্চিম ইউরোপের উচিত এখন ন্যাটোকে বিদায় করে এই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান টানা। সব যুদ্ধবাজ পক্ষকে, সব যুদ্ধ জোটকে, সব অস্ত্র ব্যবসায়ী টাইকুনের লাগাম টানার জন্য বিশ্ব জনমত গড়ার এটাই সময়।

আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুদ্র দেশগুলোর জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত একটি বড় শিক্ষা নিয়ে এল। তা হলো, কখনো কোনো বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক সামরিক জোটে নিজেকে না জড়ানো। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা জোটনিরপেক্ষ ছিলাম। সেই স্নায়ুযুদ্ধের সময় নেহরু, নাসের, টিটোর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা জোটনিরপেক্ষ জোটই এখন আবার আমাদের রক্ষাকবচ হতে পারে।

অরুণাভ পোদ্দার, চিকিৎসক ও সংস্কৃতিকর্মী

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ