মানিকগঞ্জের ঘিওরে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ করা ‘বীর নিবাস’ ঘরের তালিকায় অনিয়ম ও আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে। বেশ কয়েকজন বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকা যাচাই-বাছাই ও অনিয়মের তদন্তের দাবিতে জেলা প্রশাসকসহ বেশ কয়েকটি দপ্তরে লিখিত আবেদন করেছেন।
জানা যায়, সরকার অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বাসস্থানের জন্য বীর নিবাস স্থাপন করে দিচ্ছেন। কিন্তু মানিকগঞ্জের ঘিওরে অসচ্ছলদের ঘরে বিত্তবান ও সচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ওঠার অভিযোগ পাওয়া গেছে। ১১টি ঘরের মধ্যে অন্তত পাঁচটি ঘরের তালিকায় নাম এসেছে অবস্থা সম্পন্ন, ভূসম্পত্তির মালিক, অনুদানভোগী ও যাচাই কমিটির নেতাদের নামে। মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে বাছাই কমিটির যোগসাজশে এমনটি হয়েছে বলে অভিযোগ বঞ্চিত অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের।
অপরদিকে এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছেন যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্যরা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকারের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন নির্মাণ করে দেবে। প্রতিটি আবাসন নির্মাণে খরচ হবে প্রায় সাড়ে ১৩ লাখ টাকা। সেই ধারাবাহিকতায় মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলাতে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১১টি ঘর।
এদিকে ঘরের তালিকায় থাকা অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামের পরিবর্তে চারজন সচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম চলে আসার খবরে ফুসে উঠেছেন ঘিওর উপজেলার অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা।
উপজেলা সমাজসেবা অফিসের তথ্য মতে, অসচ্ছল ও ভূমিহীন বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আবাসন বরাদ্দ তালিকা তৈরিতে, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। সেখানে ছিলেন তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আইরিন আক্তার, পরে (তাঁর বদলির কারণে) ইউএনও মোহাম্মদ নাজমুল ইসলাম, স্থানীয় সাংসদের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মনোনীত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজবাউল খান, উপজেলা প্রকৌশলী সাজ্জাকুর রহমান ও উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান। এই কমিটি যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে ১২ জনের নাম চূড়ান্ত করে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেন। তাঁর মধ্য থেকে ১১ জনের নামের তালিকা অনুমোদন করা হয়। যেখানে অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি সচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নামও এসেছে।
তাতে দেখা গেছে, ১১ জনের নামে ঘর বরাদ্দ হয়ে আসলেও অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই বাদ পড়েছেন এ তালিকা থেকে। মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসকসহ আরও কয়েকটি দপ্তরে পাঠানো মনসুর উদ্দিন ও আব্দুস ছাত্তার নামে দুই বীর মুক্তিযোদ্ধার লিখিত অভিযোগ সূত্রে দেখা যায়, উপজেলায় বীর নিবাসের তালিকা করার ক্ষেত্রে সরকারের গৃহীত নীতিমালা লঙ্ঘন করা হয়েছে। অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বঞ্চিত করে সচ্ছলদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মনসুর উদ্দিন বলেন, ‘ঘিওর সদর ইউনিয়নে মুক্তিযোদ্ধা মুক্তার খানের বাড়িতে ৩টি পাকা টিনের ঘর। তাঁর মরহুম ছোট ভাই কুরবান আলীর স্ত্রীর নামেও বীর নিবাস বরাদ্দ আছে এবং আরেক ভাই মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ উদ্দিনের বাড়িতে বীর নিবাস স্থাপন করা হয়েছে। সিংজুরী এলাকার মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন। তিনি এ পর্যন্ত সিংজুরী ইউনিয়নে এক বিঘা জমি ও জেলা সদরের বেউথা এলাকায় বাড়ি করার মতো ৪ শতাংশ সরকারি জমি বন্দোবস্ত পেয়েছেন। তাঁর বাড়িতে দুইটি পাকা টিনের ঘর আছে। বিলে কয়েক বিঘা আবাদি জমি আছে এবং তাঁর ছেলে কাস্টমস অফিসে চাকরি করেন।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস ছাত্তার বলেন, ‘সিংজুরী ইউনিয়নে এক বিঘা খাস জমি বরাদ্দ দেওয়া আছে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমানের নামে। তাঁর বাড়িতে দুটি পাকা টিনের ঘর আছে। বিলে কয়েক বিঘা আবাদি জমিও আছে। তাঁর ছেলে পুলিশে চাকরি করছেন। এমন সচ্ছলদের নামে ঘর এসেছে। অথচ আমরা অসচ্ছলরা বঞ্চিত হব।’
এ বিষয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা লোকমান হোসেন বলেন, ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষ এবং যাচাই-বাছাই কমিটির মাধ্যমে তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এখানে কোনো অনিয়ম করা হয়নি। এ ব্যাপারে কোনো প্রকার আর্থিক লেনদেন হয়নি।’
বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজবাহ উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, ‘কমিটির সবার সম্মতিতে এ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এখানে অনিয়মের কিছু হয়নি।’
উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আব্দুল মান্নান বলেন, ‘এখানে যা কিছু হয়েছে কমিটির সদস্যদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক হয়েছে। কোনো অনিয়ম ও লেনদেনের বিষয়ে আমি জানি না।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হামিদুর রহমান বলেন, ‘আমি এই উপজেলায় নতুন যোগদান করেছি। তবে এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ফাইলগুলো দেখে, যাচাই-বাছাই করে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাব।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ আব্দুল লতিফ বলেন, ‘বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ইউএনওকে বলা হয়েছে। নির্মাণকাজের অনুমতির বিষয়টি ছাড়াও এখনো দাপ্তরিক কিছু কাজকর্ম বাকি রয়েছে। এই ঘরের তালিকায় যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে, প্রয়োজনে নতুন করে যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ঘর দেওয়া হবে। বীর নিবাস বিতরণে কোনো ধরনের অনিয়মের সুযোগ দেওয়া হবে না।’