হোম > ছাপা সংস্করণ

কবে সেই ঢাক, দেবে আবার ডাক!

আনোয়ারুল হক

ঢাকের বাজনার তালে তালে হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসবের আগমন ধ্বনিত হয়। কাশফুলের মায়া, শিউলির গন্ধ আর প্রভাতি শিশির—বাংলার এই শরৎসজ্জা তার সমস্ত রূপ-রস-গন্ধ-বর্ণ উজাড় করে অপেক্ষা করে দেবী আবাহনের। অষ্টমীর অঞ্জলি, আরতির নাচ, বোধন থেকে বিসর্জন প্রভৃতির অসাধারণত্ব গড়ে তোলে এক মধুর সামাজিক বন্ধন।

একসময় পারিবারিক স্তরেই প্রধানত দুর্গাপূজা আয়োজিত হতো। ধনী পরিবারগুলো ছিল উদ্যোক্তা এবং আয়োজিত দুর্গাপূজা ‘বনেদি বাড়ির পূজা’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময়ে এক-একটি এলাকার বাসিন্দারা যৌথভাবে যে দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু করে, তা বারোয়ারি পূজা বা সর্বজনীন পূজা নামে পরিচিত।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে সর্বজনীন পূজা শুরু হয়। হিন্দু সম্প্রদায়ের মাঝে দেবী দুর্গাকে মাথায় রেখেই দেশমাতা বা ভারতমাতা বা মাতৃভূমির জাতীয়তাবাদী ধারণা বিপ্লবের আকার নেয়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকেই বন্দে মাতরম গানটি রচিত হয়, যা ‘ইনকিলাব’ স্লোগানের মতোই তৎকালীন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা-আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র। সুভাষ চন্দ্র বসু প্রমুখ বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী নেতারা বিভিন্ন সর্বজনীন পূজার সঙ্গে যুক্ত থাকতেন এবং দেবী আবাহনের ঢাকের বাজনার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার ঢাকও বেজে উঠত। আর এভাবেই ধর্মীয় পরিমণ্ডলের বাইরেও ঔপনিবেশিকবিরোধী চেতনার সংমিশ্রণে এক সামাজিক সম্মিলন শারদোৎসবকে পরিণত করে ধর্ম-নির্বিশেষে বাঙালির উৎসবে।

আজ আর সেই দিন কই! মনে হয় ‘রিসেট বাটন’-এ অনেক আগেই চাপ পড়ে গেছে। তাই যত উৎসব আয়োজনই হোক, পূজার মণ্ডপে যতই স্থাপত্যের মুনশিয়ানা থাকুক, থিমের যতই অভিনবত্ব থাকুক, বাজার অর্থনীতির আবহে যতই বাজুক কাঁসর, যতই জমুক আসর—উপমহাদেশজুড়ে হিন্দুত্ববাদ আর ইসলামি জঙ্গিবাদের দাপটে বাঙালির উৎসবকে সুকৌশলে শুধু একটি সম্প্রদায়ের উৎসবে পরিণত করা হয়েছে।

হিন্দুধর্ম এবং হিন্দুত্ববাদ যেমন এক নয়, তেমনি ইসলামি জঙ্গিবাদও ইসলাম নয়। তেমনি ধর্মান্ধতা ও ধার্মিকতা এক নয়। তারপরেও ধর্মের নামে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো সাম্প্রদায়িক ভেদ-বিভেদ সৃষ্টি করে একসময়ের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তিকেও তাদের কাছে নতজানু করে ফেলছে।

দেশের বুকে স্বৈরাচারী শাসন উৎখাতে এক সফল ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার পরে একধরনের রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে ধর্মান্ধ উগ্রবাদী গোষ্ঠী সারা দেশে এক সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ সৃষ্টি করছে। হিন্দুধর্মাবলম্বীদের আতঙ্কিত ও সন্ত্রস্ত করে তোলা হচ্ছে। কোথাও কোথাও তাদের বাড়িঘর, দোকানপাট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, উপাসনালয় আক্রান্ত হয়েছে, প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে।

হঠাৎ করে কিশোর-তরুণদের হাতে কলেমা লেখা কালো পতাকা তুলে দিয়ে উগ্রবাদী মিছিল করা হচ্ছে। উদার সুর আর প্রীতির কুসুমের বদলে আগামী প্রজন্মকে শেখানো হচ্ছে ঘৃণার বল্লম আর হিংসার কুঠার হাতে তুলে নিতে। এটাই কি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ বিনির্মাণের পদ্ধতি? আবার এসব নিয়ে প্রতিবেশী দেশের কিছু মিডিয়ার উদ্দেশ্যমূলক অতিরঞ্জিত লাগাতার প্রচার ও তাদের দেশের কর্তাব্যক্তিদের দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি উভয় ধর্মাবলম্বীদের উগ্রতাকে উসকে দিয়ে পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।

ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর এসব কর্মকাণ্ডের নিন্দা জানালেও কণ্ঠ সোচ্চার হিসেবে প্রতিভাত না হওয়ায় আতঙ্ক, শঙ্কা, অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পূজা উপলক্ষে এক দিনের অতিরিক্ত ছুটির চেয়ে বেশি প্রয়োজন দেশের জনগোষ্ঠীর অবিচ্ছদ্য অংশ এবং সাম্প্রতিক ছাত্র গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষাসংগ্রামসহ সব জাতীয় সংগ্রামের সম-অংশীদার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনোজগতে আস্থা ও ভরসা সৃষ্টি করা। প্রয়োজন পাহাড় ও সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা ও ভরসা সৃষ্টি করা। প্রয়োজন এবারের ছাত্র আন্দোলনের ‘মস্তিষ্ক খ্যাত’ মাহফুজ আলমের ‘দায় ও দরদের সমাজের’ প্রকৃত চেহারা দৃশ্যমান করা।

দরদ আর ভরসার নামই তো জীবন। আর জীবনকে প্রাণবন্ত রেখে অস্থির এই সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের কাজ সফল করতে হলে ধর্মান্ধ উগ্রবাদী ও বিভেদের শক্তির বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তী সরকারকে হতে হবে কঠোর ও ক্ষমাহীন। তাহলেই ফিরে আসবে আস্থা। মনে রাখা দরকার, আজ যা চলছে সেটাই শেষ কথা নয়। শত শত বছরের ইতিহাস পরিক্রমায় একটি মুহূর্ত। আমরা হয়তো থাকব না। পরের প্রজন্ম লড়বে এবং মুগ্ধ হয়ে বাঙালি দেখবে নতুন লড়াকু ‘মুগ্ধরা’ অন্ধকারের শক্তিকে পরাভূত করছে।

দুর্গতি নাশ করেন বলেই তিনি দুর্গা। তাই তাঁর আগমনে অশুভ শক্তির সৃষ্ট এ ভয়াবহ সংকটমোচনের প্রার্থনা হোক ঘরে ঘরে ও মণ্ডপে। এবারের শারদোৎসবে ঢাকের তালে, আরতির নৃত্যে আর বাঁশির সুরে সৃষ্টি হোক এক উদার মানবিক সমাজ বিনির্মাণের আবাহন। লাখ লাখ শহীদের রক্তে স্বাধীন আমাদের মাতৃভূমিতে কোনো রকম ‘তথাকথিত পাহারা ছাড়াই’ ভোরের নিস্তব্ধতায় যেমন শোনা যাবে ফজরের আজান, তেমনি শোনা যাবে ভোরের নামসংকীর্তন। এটাই দায় ও দরদের সমাজ। শারদোৎসবের ঢাকও দিক সেই ডাক।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ