হোম > ছাপা সংস্করণ

বিএনপিকে মানুষ কেন ‘হ্যাঁ’ বলবে?

বিভুরঞ্জন সরকার

দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপিকে ‘না’ রোগে পেয়েছে। তারা যা চায় তা পাওয়ার অবস্থা হলে তখন বলে—না, এটা চাই না। নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন চেয়েছিল। সরকার আইন করার উদ্যোগ নেওয়ার পর বলে, না, আইন চাই না। বিএনপি ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতায় যাওয়ার বৈধ ও গণতান্ত্রিক উপায় হলো নির্বাচনে জেতা। কিন্তু নির্বাচন এলে বলে, না, নির্বাচনে যাব না। তাহলে কীভাবে ক্ষমতায় যাবে? বিএনপির একজন শীর্ষ নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হবে। তারপর নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। তারপর ‘মানবতার নেত্রী’ খালেদা জিয়াকে মুক্ত করা হবে।
 
কবে এ বিষয়গুলো ঘটবে? কবে হবে বিএনপির ইচ্ছাপূরণ? গয়েশ্বর রায় বলেছেন, সরকারের পতন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অচিরেই এই সরকারের পতন হবে। বাতি যেমন নেভার আগে জ্বলে ওঠে, সরকারের অবস্থাও নাকি তাই। কখন নিভে যাবে, তা তারা নিজেরাও টের পাবে না। 
 
যদি ধরে নেওয়া হয়, সরকার তার অবস্থা টের পাচ্ছে না, তাহলে কি এই প্রশ্ন আসে না যে, বিএনপি কি নিজের অবস্থা টের পাচ্ছে? দলটি তো কত বছর ধরে জ্বলে ওঠার কথা বলছে। কিন্তু জ্বলে ওঠার আগেই তো দপ করে নিভে যাচ্ছে। আন্দোলনের দিন-তারিখ ঘোষণা করে, আন্দোলন আর হয় না। বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দূরে সরে গেলেই সরকার পড়ে যাবে, কারণ সরকারের পায়ের নিচে মাটি নেই। সরকারের খুঁটি হয়ে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন। তাই তো হওয়ার কথা।
 
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন তো সরকারের অনুগতই হয়। বলা হয়, সরকার বিরোধী দলকে রাজপথে নামতে দেয় না। হামলে পড়ে। এটাই তো স্বাভাবিক।
 
সরকারের সহায়তা নিয়ে, সরকারের আনুকূল্য নিয়ে কি কোনো দেশে বিরোধী দল আন্দোলন-সংগ্রাম করে? জেল-জুলুমের ভয় পেলে কি নেতা হওয়া যায়? শেখ মুজিবুর রহমান কি জেলের ভয়ে কখনো পিছপা হয়েছেন? ফাঁসির দড়ি দেখেও ভীত হননি বলেই তো শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু হয়েছেন, জাতির পিতা হতে পেরেছেন।
 
বিএনপি অবশ্য বলতে পারে, কই আমাদের নেতা জিয়াউর রহমানকে তো ক্ষমতায় যেতে জেল-জুলুম সহ্য করতে হয়নি। বুদ্ধিমান হলে ক্ষমতায় যাওয়া কঠিন কিছু নয়।
 
সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তিনি সফল হয়েছেন। ১৯৭১ সালে অগ্নিঝরা মার্চে তিনি পাকিস্তানের একজন অনুগত সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে অস্ত্রবাহী ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তাঁকে দিয়ে কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করানোয় পরবর্তী সময়ে তাঁকে বানানো হলো ‘স্বাধীনতার ঘোষক’। আবার ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়েও তিনি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কৌশলের খেলা খেলে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছে যান। ক্ষমতা সংহত করতে নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারদের এক বোতলে ঢুকিয়ে ঘুঁটা দিয়ে এমন এক ককটেল রাজনীতি চালু করেন, যা কার্যত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে যায় না। ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন ২০১০ সালে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘জিয়াউর রহমান খুব চালাক ছিলেন, যাকে বলে চিকন বুদ্ধির মানুষ—তিনি অনেক বাম-ডানদের নিয়ে সার্কাস খেলেছিলেন।’ কিন্তু ‘চিকন বুদ্ধি’ তাঁর রক্ষাকবচ হতে পারেনি।
 
বিএনপি জিয়ার অনুসারী বলেই সম্ভবত দলের নেতারা জিয়ার পথই অনুসরণ করতে চান। দলটি সব সময় ক্ষমতায় যাওয়ার শর্টকাট পথ খোঁজে। সুযোগ খোঁজে ‘যদি লাইগা যায়’! কিন্তু চিকন বুদ্ধির নেতা না থাকায় দলটি বারবার ‘ধরা’ খেয়ে খেয়ে এখন এক অসহায় অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।
 
‘জোরজবরদস্তি করে কেউ ক্ষমতায় থাকতে পারে না’—এই আপ্তবাক্য উচ্চারণ করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলা বাস্তবে অর্থহীন। শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড তৈরি করেছেন। বিএনপির নীতি-কৌশলের সঙ্গে মোটাদাগে আওয়ামী লীগকে এখন আলাদা করা কঠিন বলেই মানুষ সম্ভবত বিএনপিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। বিএনপি সরকারে থেকে যেভাবে দেশ চালিয়েছে আওয়ামী লীগ তার চেয়ে খারাপ চালাচ্ছে, সেটা মানুষ মনে করে না। ক্ষমতার বাইরে থেকে বিএনপিতে কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায় না। তারা আর অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। ক্ষমতায় গেলে লুটপাটের ধারা বন্ধ করবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সংহত হবে, মানুষের জীবনমান উন্নত হবে, বিরোধী মত দমন করা হবে না–এসব অঙ্গীকার কি বিএনপি নেতৃত্ব একবারও করছে? সরকারের সবকিছুতে বিএনপি ‘না’ বলছে কিন্তু বিএনপিকে মানুষ কেন ‘হ্যাঁ’ বলবে তা পরিষ্কার করছে না।
 
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘এই যে সার্চ কমিটি যে সার্চ করছে, সেখানে স্বেচ্ছায় লোকজন মিছিল করে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশনে যাওয়ার জন্য। এতে দেশের গণতন্ত্রের কী হবে, ভোটের কী হবে, সেটা আমরা সবাই বুঝতে পারি। এই সার্চ কমিটি হুদা কমিশনের চেয়ে বড় কোনো বেহুদা সার্চ কমিটি বানানোর চেষ্টা করছে। আরও কোনো এক বেহুদাকে দিয়ে নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা চলছে। এই সার্চ কমিটি যে কমিশন করতে যাচ্ছে, তাদের আমরা আগাম প্রত্যাখ্যান করছি।’
 
বিএনপির এই প্রত্যাখ্যানে কি নির্বাচন কমিশন গঠন বন্ধ থাকবে? অনুসন্ধান কমিটি ১০ জনের নাম জমা দেওয়ার পর সেই তালিকা থেকে পাঁচজনকে নিয়ে রাষ্ট্রপতি নতুন কমিশন গঠন করার পর শুধু বিএনপি কেন, আরও অনেকে প্রত্যাখ্যান করলেও কি এখন কমিশন বাতিল হয়ে যাবে? সরকার তো সরকারের পছন্দের লোক নিয়েই কাজ করবে। কারণ সরকার কখনো এই প্রতিশ্রুতি দেয়নি যে তারা বিএনপির কথামতো কাজ করবে। কোনো গণতান্ত্রিক দেশে কি সরকার বিরোধী দলের পছন্দ অনুযায়ী প্রশাসন সাজায়? পৃথিবীর কোনো দেশে এমন উদার রাজনীতি চলছে? 
 
সবকিছুতে না বলার বা বিরোধিতা করার রাজনীতি বিএনপিকে শেষ পর্যন্ত কি কোনো সফলতা দেবে? অতীত অভিজ্ঞতা এটাই বলে যে সরকারকে বেকায়দায় বা চাপে ফেলতে গিয়ে এখন পর্যন্ত বিএনপি যতবার যত কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে, ততবারই তারা নিজেরাই চাপে বা বেকায়দায় পড়েছে। এর আগে একাধিকবার বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলনের ডাক দিয়েছে, সরকার পতনের দিন-তারিখ নির্ধারণ করেছে, জামায়াতের মতো যুদ্ধাপরাধীদের গঠিত দলের সহযোগিতা নিয়ে দেশে ব্যাপক সন্ত্রাস-সহিংসতা করেছে, কিন্তু তার পরিণতি কী হয়েছে? বিএনপি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে বর্তমানে সব থেকে কমজোরি অবস্থায় আছে।
 
এর আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি তাদের পছন্দের পরিবেশ তৈরি করতে পারেনি। পরের নির্বাচনে পারবে—তার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না; বরং বিএনপি নির্বাচনের ব্যাপারে স্ববিরোধী অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা বলছে, আবার দলের লোকজন স্বতন্ত্র পরিচয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন, জয়লাভও করছেন। বিজয়ীদের দল থেকে বের করেও দেওয়া হচ্ছে না। গত সংসদ নির্বাচন নিয়ে কঠোর নিন্দা-সমালোচনা করছে, সংসদের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে, আবার দলের বিজয়ী সংসদ সদস্যরা সংসদীয় কার্যক্রমে অংশও নিচ্ছেন। মানুষ কি বিএনপির এই স্ববিরোধী অবস্থানকে নৈতিকভাবে সঠিক মনে করছে? এতে কি বিএনপির জনপ্রিয়তা বাড়ছে?
 
বিএনপি যদি তাদের মনমতো সরকার না পায়, অর্থাৎ আগামী নির্বাচনও যদি বর্তমান সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে কি নির্বাচন থেকে বাইরে থাকবে? সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করার মতো আন্দোলন কি বিএনপির পক্ষে গড়ে তোলা সম্ভব হবে? বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট বা মৈত্রী গড়ে বিএনপি বড় ধরনের আন্দোলনের পরিকল্পনা করছে বলে শোনা যাচ্ছে। সরকার পতনের আগামী আন্দোলনে বর্তমান ২০ দলীয় জোটের বাইরে কোন কোন দল বিএনপির নতুন মিত্র হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে সরকারের বিরুদ্ধে থাকলেও সব দল যে বিএনপির বৃহত্তর ঐক্যের ছাতার নিচে মাথা রাখবে না, তা এখনই বলা যায়। যারা রাজনীতির অতীত থেকে কিছু শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না, তারা বারবার চুন খেয়ে মুখ পোড়াতে পারে, কিন্তু সাধারণ বোধ-বুদ্ধি থাকলে ভুল রাস্তায় কারও হাঁটার কথা নয়। সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম দিন কয়েক আগে এটা স্পষ্ট করেই বলেছেন, বিএনপির যে আদর্শিক অবস্থান তাতে সিপিবি অন্তত বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার পথ মসৃণ করার জন্য শতরঞ্জি বিছিয়ে দিতে এগিয়ে যাবে না।
 
সবচেয়ে বড় কথা, যেকোনো আন্দোলন সফল করতে হলে বিশ্বাস করার মতো একটি মুখ প্রয়োজন হয়। আন্দোলনের পেছনে একটি আস্থা রাখার মতো মুখ না দেখলে মানুষ জীবনবাজি রাখতে চায় না। বিএনপির বড় সংকট তাদের কাছে ব্যাপক মানুষের আস্থাভাজন গ্রহণযোগ্য কোনো মুখ নেই। মানুষের সঙ্গে থেকে, লাগাতার লেগে থেকে তাদের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার মতো উজ্জ্বল মুখ বিএনপি ও তার মিত্রদের মধ্যে একটিও নেই। যাঁরা আছেন, তাঁরা ডিগবাজি বিশারদ এবং আগে নিজেরটা গুছিয়ে নিয়ে তারপর দেশ বা দেশের মানুষের কথা ভাবেন।
 
বিভুরঞ্জন সরকার: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা 

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ