শিল্পের প্রধান একটা কাজ হলো, যা চোখে পড়ে না, তা চোখে পড়িয়ে দেওয়া। সচরাচর যা ঘটছে চোখের সামনে, কজন আর তা খেয়াল করে? দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গেলে অনেক কিছুই চোখে পড়ে না।
সৈয়দ শামসুল হক গেছেন লন্ডনের টেট গ্যালারিতে। সেখানে নানা ধরনের ছবি রয়েছে। একটি ছবির দিকে চোখ আটকে গেল তাঁর। ছবির নাম, ‘নাশতার টেবিল’।
সাদামাটা ছবি: একটা ছোট চৌকো টেবিলের ওপর প্লেটে রাখা দুটো পোচ করা ডিম। একটি সসেজ। কিছু শিমবিচি, টমেটো সসে ভেজানো। পাশে একটা প্লেট। তাতে দুটো রুটি টোস্ট করে রাখা। চায়ের কাপ-পিরিচ। রয়েছে একটা অ্যাশট্রে এবং তাতে আধপোড়া একটা সিগারেট।
ছবিটি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, কেউ একজন খেতে বসেছিল, কিন্তু পুরোটা খায়নি। অনেকটাই পড়ে আছে। বিচ্ছিরি রকম এঁটো হয়ে আছে খাবারটা।
যা বলা হলো, তা এতটাই সহজ-সরল ব্যাপার যে তাতে বিস্ময়ের কোনো জায়গা নেই। বিস্ময়ের জায়গাটা খুঁজতে হবে ছবিতেই। ছবিটা চিত্রকর আঁকেননি। তিনি আসল প্লেট পিরিচ কাপ সিগারেট খাবার ইত্যাদি গঁদ ও প্লাস্টিক স্প্রে দিয়ে টেবিলের ওপর সেঁটে দিয়েছেন। তারপর সেটাই ঝুলিয়ে দিয়েছেন খাড়া করে। ব্যস! হয়ে গেল চিত্রকর্ম!
প্রশ্ন উঠবে, এটাকে চিত্রশিল্পীর আঁকা ছবি বলা হচ্ছে কেন?
এ নিয়ে অনেক ভেবেছেন সৈয়দ হক। তারপর নিজের মতো করে উত্তর তৈরি করেছেন। প্রতিদিন নাশতার টেবিলে বসি আমরা, কিন্তু সামনে থাকা খাদ্যবস্তুগুলোর দিকে বিশেষভাবে নজর দিই না। কী ছিল নাশতার টেবিলে, তা মনে রাখার কোনো দায় নেই আমাদের। কিন্তু সেই জিনিসগুলোই যখন ঠিক সেভাবে রেখে দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হলো, অমনি তা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে ঢুকে গেল। আমরা তন্ময় হয়ে তা দেখলাম!
এ ছবিটি দেখার পর নাশতার টেবিলের প্রতি কেউ নিরাসক্ত থাকবে না।
সূত্র: সৈয়দ শামসুল হক, হৃৎকলমের টানে, পৃষ্ঠা ২৩৩-২৩৪