হোম > ছাপা সংস্করণ

শিক্ষানীতি ও ব্যবস্থার যেসব সংস্কার দরকার

আবুল কাসেম ফজলুল হক

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার অবস্থা ভালো নয়। অন্ধভাবে সাম্রাজ্যবাদী নীতি গ্রহণ করে চলার ফলে কোনোটাই স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। যেভাবে সেমিস্টার-পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, তাতে উচ্চশিক্ষাকেও পরীক্ষামুখী করে ফেলা হয়েছে। পরীক্ষা আর শিক্ষা যে এক নয়, কেবল পরীক্ষার ফল ভালো করলেই যে কেউ শিক্ষিত হয় না, গোটা জাতিকে এটা বুঝতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা নেই। পরীক্ষাসর্বস্ব এই শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষা নিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক—কারও আনন্দ নেই। এ অবস্থায় আশির দশক থেকেই ব্যাপক প্রসার ঘটেছে কোচিং সেন্টার, গাইড-বুক ইত্যাদির। এগুলোতে শিক্ষার কোনো আয়োজনই নেই, আছে কেবল পরীক্ষার ফল ভালো করানোর আয়োজন।

শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে, পরীক্ষার ফল খুব ভালো করছে, দ্রুত সৃজনশীল হচ্ছে। যারা উদ্যোগী ও পরিশ্রমী, তারা বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎহীন ভেবে ইউরোপে, আমেরিকায়, অস্ট্রেলিয়ায় নানা রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব নিচ্ছে। ব্রেইন ড্রেইন সম্পূর্ণ নতুন রূপ নিয়েছে। দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ, সুনাগরিকের গুণাবলি ও জ্ঞান অর্জন হচ্ছে না।

দেশের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে যত আলোচনা করা হবে, ততই এর ত্রুটি-বিচ্যুতি ও বিকৃতির দিকগুলো সামনে আসবে। জনগণের জন্য অনভিপ্রেত অবাঞ্ছিত অনেক কিছুকে কায়েমি-স্বার্থবাদীরা ক্রমাগত তাদের মনমতো করে প্রচার করছে।

বাংলাদেশে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। এর জন্য প্রথম পর্যায়ে দরকার সর্বজনীন কল্যাণে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের দূরদর্শী চিন্তাভাবনা, আলোচনা-সমালোচনা ও বিচার-বিবেচনা। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে সেই লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে চেষ্টা চালালে সমাধানযোগ্য সব সমস্যারই সমাধান করা যাবে। লক্ষ্য ও যাত্রাপথ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নিয়ে এগোতে হবে।

রাষ্ট্রব্যবস্থায় ও শিক্ষাক্ষেত্রে যে অবস্থা বিরাজ করছে, তাতে সহজে এর উন্নতি সাধন সম্ভব হবে না। অগ্রাধিকার ঠিক করে পর্যায়ক্রমে এগোতে হবে। প্রথম পর্যায়ের কাজের জন্য নিচের বিষয়গুলো কর্মসূচিভুক্ত করা যেতে পারে:

১. প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত রেখে এর মান উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাথমিক হচ্ছে পরবর্তী সব শিক্ষার ভিত্তি। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণির পাবলিক পরীক্ষা বাতিল করতে হবে। স্কুল থেকে প্রাথমিক ও নিম্নমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপনের সনদ দেওয়া হবে এবং এগুলোর প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থাকবে।

২. কথিত সৃজনশীল পরীক্ষা-পদ্ধতি পরিবর্তন করে এমন পদ্ধতি প্রবর্তন করতে হবে, যা শিক্ষার্থীদের মনে পাঠানুরাগ, অনুসন্ধিৎসা, জ্ঞানস্পৃহা, স্বাজাত্যবোধ, সামাজিক সম্প্রীতি, দেশপ্রেম, সুনাগরিকত্ববোধ ও উন্নত জীবনের আকাঙ্ক্ষা জাগাবে। পরীক্ষার জন্য মূলত বর্ণনামূলক উত্তরের পদ্ধতিকে নবায়িত ও বিকশিত করে কার্যকর করতে হবে। শিক্ষার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের আনন্দের যোগ ঘটাতে হবে। বর্তমানে শিশু-কিশোরেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করে শিক্ষার্থী হিসেবে, কিন্তু তার পরেই তারা বইয়ের বোঝা পিঠে নিয়ে পরীক্ষার্থী হয়ে যায়, শিক্ষার্থী আর থাকতে পারে না। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। রাষ্ট্রীয় সংবিধান ও জাতীয় শিক্ষানীতির আওতায় শিক্ষা বোর্ডগুলোকে স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, ইউনেসকো ও ইউনিসেফের অন্ধ-অনুসারীরা পরীক্ষা-পদ্ধতির অভিপ্রেত পরিবর্তন সাধনে বাধা দেবে।সাম্রাজ্যবাদী ও তাদের অনুসারীরা দুর্বল জাতিগুলোর শিক্ষার উন্নতি চায় না, তারা কেবল ভালো সনদ দিয়ে পরীক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সন্তুষ্ট রাখার ব্যবস্থা চায়। জ্ঞানেই শক্তি, জ্ঞানেই কল্যাণ—বৃহৎ শক্তিরা এটা বোঝে এবং জ্ঞানকে তারা কেবল নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।

৩. ইংলিশ ভার্সন বিলুপ্ত করতে হবে। যাঁরা সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি রাষ্ট্রে নাগরিক করার জন্য কিংবা বড় চাকরি পাওয়ার জন্য ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চান, তাঁদের জন্য ব্রিটিশ সরকার কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ও স্থানীয় ব্রিটিশ কাউন্সিলের মাধ্যমে ‘ও’ লেভেল, ‘এ’ লেভেল চালাচ্ছে। তা ছাড়া, আছে বিদেশি সরকার দ্বারা পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যমের আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সেসবের পাশে ইংলিশ ভার্সনের দরকার নেই। ইংলিশ ভার্সনের জন্য যে অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে তার দ্বারা রাষ্ট্র, জাতি ও জনগণের কোনো কল্যাণ হচ্ছে না।

বাংলাদেশে যাঁরা আজকাল কেবল বিশ্বমান অর্জনের কথা বলেন, তাঁরা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় অস্তিত্ব ও জনজীবনের অবস্থার কথা একটুও ভাবেন না। যাঁরা দ্বৈত নাগরিক, যাঁদের স্ত্রী অথবা স্বামী অথবা সন্তান দ্বৈত নাগরিক কিংবা বিদেশি নাগরিক, তাঁরা যাতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপসচিব থেকে সচিব, জজকোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইত্যাদি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হতে না পারেন, সংবিধানে তার বিধান রাখতে হবে। শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য হবে বাংলাদেশের ভূভাগে উন্নত জনজীবন, উন্নত জাতি ও শক্তিশালী রাষ্ট্র গড়ে তোলা। জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের মূলনীতি হবে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সর্বজনীন কল্যাণ।

৪. প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বাংলা ভাষা শেখার ব্যবস্থাকে যথাসম্ভব উন্নত করতে হবে। সারা দেশের সব শিশুকে বিদেশি ভাষা শেখানোর দরকার নেই।জাতীয় চাহিদা অনুযায়ী সংখ্যা নির্ধারণ করে নির্দিষ্টসংখ্যক প্রতিষ্ঠানে ইংরেজি ও আরও কয়েকটি বিদেশি ভাষা ভালো করে শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, পৃথিবীর উন্নত ও অনুন্নত কোনো রাষ্ট্রেই সব শিশুকে বিদেশি ভাষা শেখানো হয় না।

৫. পেশামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করতে হবে। এটা করা গেলে ঝরে পড়ার সমস্যার সমাধান হবে। পেশামূলক শিক্ষার এই দুই ধারার পাঠ্যসূচিতেই পেশামূলক বিষয়গুলোর সঙ্গে বাংলা ভাষা, জাতীয় ইতিহাস, পৌরনীতি ও নীতিশিক্ষাকে আবশ্যিক বিষয়রূপে স্থান দিতে হবে। পেশামূলক শিক্ষার এই দুই ধারার বাইরে মূলধারার বাংলা মাধ্যমে নবম ও দশম শ্রেণিতে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিক শাখাকে একীভূত করে এক ধারায় পরিণত করতে হবে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে মানববিদ্যা, বিজ্ঞান ও বাণিজ্য—এই তিন শাখা থাকবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে জাতীয় ইতিহাস, পৌরনীতি ও নীতিশিক্ষাকে বাধ্যতামূলক বিষয়রূপে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মূলধারার বাংলা মাধ্যমের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যসূচি, পাঠক্রম ও পাঠ্যপুস্তক উন্নত করতে হবে। মানববিদ্যা, বিজ্ঞান, বাণিজ্য, চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ইত্যাদি সব ধারার উচ্চশিক্ষার ভিত্তিরূপে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার তিন শাখার পাঠ্যসূচিকে পুনর্গঠিত করতে হবে।সারা দেশে গরিবদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যাপ্ত বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। পরীক্ষার ফল ও অন্যান্য দিক বিচারে মেধাবী শিক্ষার্থীদের পুরস্কৃত করতে হবে।

৬. মাদ্রাসার বেলায় মাদ্রাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। যে অবস্থা চলছে তাতে বিরোধমূলক নীতি পরিহার করে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে অগ্রাধিকার দিয়ে উন্নতির নীতি গ্রহণ করতে হবে। সবকিছু করতে হবে রাষ্ট্রের সংবিধানের আওতায় থেকে।

৭. উচ্চশিক্ষায়, গবেষণায়, বিচারব্যবস্থায়, ব্যাংকিং ও জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চায় বাংলা ভাষা অবহেলিত বলেই বর্তমান পর্যায়ে বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। বাংলা ভাষা, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা, ধর্মীয় ভাষা ও বিদেশি ভাষা ইত্যাদি বিবেচনা করে সুষ্ঠু জাতীয় ভাষানীতি অবলম্বন করতে হবে। জাতীয় পর্যায়ে জনজীবনের বৈচিত্র্য ও ঐক্য দুটোতেই যথোচিত গুরুত্ব দিয়ে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ও সবার উন্নতির নীতি অবলম্বন করতে হবে। এসব নিয়ে চিন্তায় ও মতপ্রকাশে বিবেকবান চিন্তাশীল ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।

৮. শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে যেন
ক. সারা দেশে বিভিন্ন ধারার পেশামূলক শিক্ষার মাধ্যমে বৃহত্তমসংখ্যক যোগ্য, দক্ষ, উৎপাদনক্ষম, উন্নত-চরিত্রবলসম্পন্ন কর্মী সৃষ্টি হয়; 
খ. শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে শক্তিমান রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশকে গড়ে তোলার ও ভালোভাবে পরিচালনা করার উপযোগী শিক্ষিত লোক তৈরি হয়; অধিকন্তু গ. দর্শন,  বিজ্ঞান,  ইতিহাস,  শিল্প-সাহিত্য, প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রকৃত জ্ঞানী ও সৃষ্টিশীল ব্যক্তিদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। 

আরও অনেক গুরুতর বিষয় আছে, 
যেগুলোকে পর্যায়ক্রমে কর্মসূচিভুক্ত করে নিয়ে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের সামনে আছে অজস্র সমস্যার মধ্যেও মহান সব সম্ভাবনা। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি সম্ভাবনার বাস্তবায়ন সম্ভব। জনসাধারণকে জাগতে হবে, ঘুমিয়ে থাকলে কোনো সম্ভাবনাই বাস্তবায়িত হবে না। কর্মসূচি গ্রহণ করে তার বাস্তবায়নের জন্য গড়ে তুলতে হবে সংঘশক্তি। জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের জন্য পর্যায়ক্রমে সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও পরিচ্ছন্ন কর্মসূচি নিয়ে কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। এ অবস্থায় বাংলাদেশকে সর্বজনীন গণতন্ত্র অবলম্বন করে জনগণের স্বাধীন প্রগতিশীল গণরাষ্ট্ররূপে গড়ে তোলা আমাদের কেন্দ্রীয় কর্তব্য। এ জন্য জাতীয়তাবাদ ও তার সম্পূরক আন্তর্জাতিকতাবাদ অবলম্বন করে শিক্ষাব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে। তাই শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার দরকার।

লেখক: অধ্যাপক ও রাষ্ট্রচিন্তক

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ