ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর দিকে অর্থনীতিবিদেরা আশঙ্কা করেছিলেন, রাশিয়ার অর্থনীতি পুরোটাই ধসে পড়বে। এ সময় রাশিয়ার অর্থনীতি ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হয়। গত মার্চে অলিগার্ক ওলেগ দেরিপাস্কার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল, নিষেধাজ্ঞার মুখে আগামী বছর রাশিয়ার অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। যুদ্ধ করার সব অর্থ নিঃশেষ হয়ে যাবে। তবে সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এখনো টিকে আছে রাশিয়া।
আইএমএফের প্রথাগত পদ্ধতিতে কিছু বিশেষজ্ঞ একটি দেশের অর্থনীতি মূল্যায়নের সমালোচনা করেন। যুদ্ধের সময় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাব দিয়ে দেশের অর্থনীতি বিচার করা অসম্ভব। সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের (সিপিআর) বিশেষজ্ঞ প্যানেলের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত বছর সরকারি হিসাবের চেয়ে মন্দা ছিল দুই গুণ বেশি।
২০২২ সালে রাশিয়ার জিডিপি কমেছে। তবে যতটা ধারণা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক কম। ফেব্রুয়ারিতে আইএমএফ বলেছিল, চূড়ান্ত পরিসংখ্যানে ২০২২ সালে জিডিপিতে ২ শতাংশ মৃদু পতন দেখা যাবে, ২০২৩ সালে জিডিপি নিম্নমুখী অবস্থান থেকে সরে এসে শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ বাড়বে এবং ২০২৪ সালে গিয়ে তা দাঁড়াবে ২ শতাংশে। এই পরিসংখ্যান ধারণা দেয় যে সাড়ে ১৪ কোটি জনসংখ্যার অর্থনীতি অনেক শক্তিশালী এবং যুদ্ধের অতিরিক্ত ব্যয় বহনে যথেষ্ট সক্ষমতা রাখে।
এই হিসাবে সামরিক ব্যয়ও যোগ করা হয়েছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সামরিক খাতে ব্যয় বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। মূলত গত বছর ১ লাখ ২০ হাজার নাগরিককে সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার পর টাকার অঙ্কটা বেড়েছে। নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদ মিখাইল মামোনভ সরাসরি যুদ্ধে জড়ানো একটি রাষ্ট্রকে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি দিয়ে মূল্যায়নের বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, বাজার ব্যয় ১০ শতাংশ কমেছে এবং প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার অর্থনীতি ব্যাপক সংকোচনের মুখে পড়েছে।
ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের অ্যাড্রিয়ান স্মিথ এবং গ্রোনিংজেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হান্না সাখনো সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চের একটি সমীক্ষায় বেসরকারি খাতের কার্যকলাপ পরিমাপের জন্য একটি ট্র্যাকার তৈরি করেন। এ জন্য গুগলে অনুসন্ধান, বিমানের টিকিট কেনা এবং বাড়ির দামসহ ১৫ ধরনের উৎস থেকে তথ্য নেওয়া হয়।
অ্যাড্রিয়ান ও হান্নার মতে, গত বছর সরকারি হিসাবের চেয়ে রাশিয়ার অর্থনৈতিক মন্দা ছিল অনেক বেশি। সরকারি হিসাবে ব্যক্তিগত খরচ ১ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে বলে দেখানো হলেও বাস্তবে ছিল তা ৪ শতাংশ।
২০২২ সালের ডিসেম্বরের হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ায় বছরে প্রায় ২০ শতাংশ আমদানি কমেছে, প্রযুক্তি খাতে আমদানি কমেছে ৩০ শতাংশ। গত বছর গাড়ি ও খননকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির উৎপাদন যথাক্রমে ৬৭ ও ৫৩ শতাংশ কমেছে। এসব পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় সরবরাহ ঘাটতিতে উল্লেখযোগ্য হারে উৎপাদন কমে গেছে।
সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং পছন্দসই পণ্যে নিষেধাজ্ঞার কারণে গত মার্চ থেকে সাধারণ মানুষ কেনাকাটায় খরচ কমিয়েছে এবং এ বছরও তা অব্যাহত থাকবে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কায় পরিবারগুলো তাদের অর্থ সঞ্চয়ী অ্যাকাউন্টে জমা করছে। ফলে উন্নত বিশ্বে আমানত সঞ্চয়ে রাশিয়ার অবস্থান সবার ওপরে, প্রায় ৪২ শতাংশ; যেখানে যুক্তরাজ্যে মাত্র ৯ শতাংশ।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নিষেধাজ্ঞা বিশেষজ্ঞ ও রাশিয়ান অভিবাসী ওলেগ ইতসখোকি বলেন, ‘আমরা জানি না রাশিয়ার হাতে এখনো কী পরিমাণ অর্থ আছে, তবে বেশি যে নেই, এটা বিশ্বাস করাই বেশি যুক্তিসংগত।’
ওলেগ ইতসখোকি আরও বলেন, নতুন সৈন্যদের বেতন, ধ্বংস হয়ে যাওয়া ট্যাংক এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিস্থাপনের জন্য সামরিক ব্যয় বেড়েছে। ২০২১ সালে মোট জিডিপির ৪ দশমিক ১ শতাংশ ব্যয় করা হয় সামরিক খাতে। গত বছর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ শতাংশে।
যুদ্ধে যেসব পরিবার স্বজন-সন্তান হারিয়েছে, তাদের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এতে খালি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় কোষাগার। সরকারি খরচ বেড়েছে নাটকীয়ভাবে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জানুয়ারিতে এটি ৫৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বিষয়টিকে অর্থনীতির অবমূল্যায়ন হিসেবে ধরা যেতে পারে।
শুধু খরচই বাড়েনি, দ্রুত সরকারের আয়ও কমেছে। রাশিয়ার কর্মীদের গড় আয় কম। এ জন্য তারা আয়করও খুব কম দেয়। ২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের এক হিসাব অনুযায়ী, রাশিয়ার মাথাপিছু আয় মাত্র ১২ হাজার ২০০ ডলার, যেখানে যুক্তরাজ্যের মাথাপিছু আয় ৪৬ হাজার ৫১০ ডলার।
রাশিয়ায় কর্মীদের আয়করের হার ১৩ শতাংশ। ২০২১ সালে ৫০ লাখ রুবল আয় করেন, এমন ব্যক্তিদের জন্য আয়করের হার ১৫ শতাংশ করা হয়। প্রথম বছরে অতিরিক্ত ৮ হাজার ৩০০ কোটি রুবল আয়কর সংগ্রহ করে রাজস্ব বিভাগ। তবে তেল এবং গ্যাস বিক্রি করে রাশিয়া যে পরিমাণ রাজস্ব আয় করে, এ অর্থ তার তুলনায় খুবই নগণ্য।
করোনার সময় এবং গত বছর যখন জ্বালানির দাম অনেক বেশি ছিল, তখন তেল ও গ্যাস রপ্তানি করে বিপুল রাজস্ব আয় করেছে রাশিয়া। তবে সাম্প্রতিক সময়ে জ্বালানিতে আয় কমে যাওয়ায় যুদ্ধের জন্য অর্থের জোগান দিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। সরকারি তথ্যানুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারিতে তেল ও গ্যাস থেকে রাজস্ব আয় গত বছরের তুলনায় ৪৬ শতাংশ কমেছে।
অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, উচ্চ ব্যয় এবং আয় কমে যাওয়ায় রাশিয়ার জনসাধারণের ব্যয় ঘাটতি জানুয়ারিতে ২৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এর অর্থ হলো, বর্তমানে বিদ্যমান বার্ষিক ঘাটতি ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে সামনের দিনগুলোতে আরও বেড়ে যাবে। ২০২২ সালে বছর শেষে উদ্বৃত্ত ছিল ২৫০ বিলিয়ন ডলার, ২০২৩ সালের শেষে দিকে এই অর্থ নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকছে।
রুশ তেল কোম্পানিগুলোকে পুতিন বলেছেন, শুধু উচ্চ দামে বিক্রি করা ব্রেন্ট ক্রুডের ওপর কর ধার্য করা হবে, কম দামে বিক্রি উরাল ক্রুডের জন্য কর প্রযোজ্য নয়।
ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্সের উপপ্রধান অর্থনীতিবিদ এলিনা রিবাকোভাসহ একদল বিশেষজ্ঞ অর্থনীতিবিদের মতে, কিছু রাশিয়ান তেল কোম্পানি ব্যারেলপ্রতি যে বিক্রিমূল্য পেয়েছে, তা উরাল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ভালো, তবে বেশি নয়। অর্থনীতিবিদদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে তেল পণ্যের ওপর ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার রপ্তানি ও রাজস্ব আয়কে আরও সংকুচিত করে তুলবে।
পূর্ব ও দক্ষিণে পর্যাপ্ত পাইপলাইনের অভাবে গ্যাস রপ্তানি কমে গেছে। খনি ও সার কোম্পানিগুলো বৈশ্বিক দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় গত দুই বছরে যে লাভ করেছে, তার জন্য এককালীন সারচার্জ দিয়েছে।
এ ছাড়া অন্যান্য পদক্ষেপের মধ্যে আয়কর বাড়ানো এবং সঞ্চয়ের ওপর কর আরোপের মতো বিষয়গুলোও বিবেচনায় রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে অর্থ স্থানান্তরের জন্য আর্মেনিয়া ও তুরস্কের মাধ্যমে সুইফট পেমেন্ট ব্যবহার করে রাশিয়া। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করছে এ পথটিও বন্ধ করে দিতে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পুতিন চেয়েছিলেন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেব্রুয়ারিতে যেন সুদহার কমিয়ে আনে। যাতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ নিয়ে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারে। ব্যাংকের গভর্নর এলভিরা নাবিউলিনা বলেন, ঋণের খরচ কমানো হলে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে, যা বর্তমানে ১২ শতাংশের কাছাকাছি। গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শেষ বৈঠকে সুদহার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ স্থির করা হয়।
যুদ্ধের কারণে রাশিয়ার মনোযোগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে রাশিয়ায় উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং উচ্চ সুদহার বহাল তবিয়তেই থেকে যাচ্ছে। গত বছর তেল ও গ্যাস রুবলে বিক্রির কারণে মুদ্রাটির দাম বেড়ে গেলেও আমদানি খরচের কারণে তা আবার নিম্নমুখী রূপ নিয়েছে।
মামোনভ ও ইতসখোকির মতে, তেলে রাজস্ব হ্রাস, রুবলের পতন, বিদেশি ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার ওপর বিধিনিষেধ এবং জনমনে আতঙ্ক—সবকিছু মিলিয়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা উতরে যাওয়া খুবই কঠিন কাজ। দেরিপাস্কার ভবিষ্যদ্বাণী মেনে নিলে দেখা যাবে ২০২৪ সালের মধ্যে যুদ্ধ করার সব অর্থই ফুরিয়ে গেছে।
(গার্ডিয়ান থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন মোশারফ হোসেন)