হোম > ছাপা সংস্করণ

পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ড: রাসায়নিকপল্লির আক্ষেপ

মর্তুজা হাসান সৈকত 

পুরান ঢাকায় রাসায়নিক কারখানা-গুদাম থেকে সৃষ্ট অগ্নিদুর্ঘটনা যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুদিন পরপরই ঘটছে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। ৫ নভেম্বর রাতে পুরান ঢাকার সোয়ারীঘাটের কামালবাগে রোমানা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি জুতার কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ৯ নভেম্বর বিকেলে চকবাজারের মিটফোর্ড রোডের এস কে টাওয়ার নামের ছয়তলা ভবনের তৃতীয় তলায় প্লাস্টিকের গুদামেও আগুন লাগে। এস কে টাওয়ারের অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের খবর পাওনা না গেলেও সোয়ারীঘাটের অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছে পাঁচ শ্রমিকের।

ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, রোমানা রাবার কারখানাটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় ছিল। বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক, জুতার সোল তৈরির এডহেসিভ এবং জুতা তৈরিতে ব্যবহার করা ডিওপি তেল সেখানে মজুত করা ছিল। যার সবই দাহ্য পদার্থ। এমন একটি বিপজ্জনক জায়গায় বিশেষ কায়দায় স্টিলের পাটাতনের ওপর শ্রমিকদের ঘুমানোর ব্যবস্থা ছিল। ফলে গভীর রাতে আগুন লাগার পর শ্রমিকদের আর বাঁচার পথ ছিল না। ফায়ার সার্ভিস যতক্ষণে এই আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছে, ততক্ষণে আগুনে পুড়ে লাশগুলো এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া লাশগুলো হস্তান্তর করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট। মূলত কিছু অপরিণামদর্শী মানুষের লোভের কারণে বারবার অগ্নিকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন এই এলাকার সাধারণ মানুষ। ২০১০ সালে নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মারা যায় ১২৪ জন। এ ছাড়া ২০১৯ সালে চুড়িহাট্টায় রাসায়নিকের গুদাম বিস্ফোরণ থেকে লাগা আগুনে পুড়ে মারা গেছে আরও ৭১ জন। ঠিক একইভাবে কিছুদিন আগে আরমানিটোলায় মারা গেছে ৫ জন।

পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি বিস্ফোরণের কারণ রাসায়নিক দ্রব্য অথবা দাহ্য পদার্থের গুদাম-কারখানা। অথচ নিমতলীর মর্মান্তিক ঘটনার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে রাসায়নিকের গুদাম ও দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে তৈরি পণ্যের কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু অজানা কারণে প্রকল্পটি আর এগোয়নি। এর পরিবর্তে বেশ দেরি করে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে রাসায়নিকপল্লি স্থানান্তরে নতুন আরেকটি প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে সেখানেও অবকাঠামো নির্মাণকাজে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে।

বারবার অগ্নিকাণ্ডে মোটাদাগের একটি কারণ হচ্ছে, পুরান ঢাকার বেশির ভাগ বাড়ির মালিক বেশি ভাড়ার লোভে বাসার নিচতলায় রাসায়নিক পদার্থ মজুতের জন্য ভাড়া দেন। এই কারখানা ও গুদামগুলোর বেশির ভাগেরই নেই পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদপ্তর কিংবা ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র। অপরদিকে, সরকারি বিভিন্ন সংস্থাও রাসায়নিক আমদানির অনুমোদন দিয়ে সেটা কোথায় রাখা হচ্ছে, কীভাবে রাখা হচ্ছে এর খোঁজ রাখে না। ব্যাপারটা এমন যে, অনুমোদন দিয়েই দায়িত্ব শেষ। কোনো সংস্থা আবার লাইসেন্স দেওয়া বন্ধ রাখলেও অবৈধ ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নেওয়া হয় না কোনো পদক্ষেপ। এই সবকিছুর ইক্যুয়েশন হচ্ছে, নিমতলী, চুড়িহাট্টা আর সোয়ারীঘাটের মতো ট্র্যাজেডিগুলো। কিছুদিন আগেও বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর আশপাশের এলাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ যেসব বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থের মজুত রয়েছে, তা বৈরুত বন্দরে যেসব রাসায়নিক পদার্থ মজুত ছিল, তার চেয়েও কয়েক গুণ বেশি।

এসব গুদামে রয়েছে ভয়ংকর সব রাসায়নিক দাহ্য পদার্থ। এই রাসায়নিক পদার্থ সামান্য আগুনের স্পর্শে এলেই ঘটতে পারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। বৈরুতে লোমহর্ষক বিস্ফোরণের পর বিপজ্জনক পদার্থ বা রাসায়নিক কারখানাগুলো নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নিচ্ছে অনেক দেশ। অস্ট্রেলিয়ার সরকার সিডনিতে মজুত করা অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।

ভারতও চেন্নাইয়ের ৭০০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। পুরান ঢাকায় অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটসহ বিপজ্জনক সব রাসায়নিক পদার্থের বিপুল মজুত থাকলেও তা সরানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই।

উল্লেখ্য, খননশিল্পে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। বোমা তৈরিতেও এই রাসায়নিক পদার্থটি বহুলভাবে ব্যবহৃত। এমন বৈশিষ্ট্যের কারণে এটিকে খুবই সতর্কতার সঙ্গে মনুষ্য বসতির বাইরে সংরক্ষণ করতে হয়।

অপরদিকে, সার উৎপাদনেও আবার এই রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার রয়েছে। তবে সার কারখানাগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকলেও অধিকাংশ অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মজুত করে রাখা হয় কেবল পুরান ঢাকার বিভিন্ন গুদামে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর বলছে, পুরান ঢাকার গুদামগুলোয় বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য যেমন ড্রামভর্তি করে মজুত করা হয়, তেমনি অনেক গুদামে মজুত থাকে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক, জুতার সোল তৈরির এডহেসিভ ও পেস্টিং সলিউশন, যার সবই দাহ্য পদার্থ।

বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এর মধ্যে বেশ কিছু রাসায়নিকের এক একটি ড্রাম এক হাজার বোমার চেয়েও বেশি শক্তিশালী; যা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে পুরান ঢাকার অধিকাংশ জায়গাই পুড়ে যেতে পারে। কারণ, এসব গুদামের কোনোটাতেই অগ্নিকাণ্ড নিরোধকের তেমন ব্যবস্থা নেই। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) ২০১৭ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পুরান ঢাকায় রয়েছে ২৫ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন বা রাসায়নিক দাহ্য বস্তুর গুদাম। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে বাসাবাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। কোনো ধরনের মনিটরিং ছাড়াই যেখানে-সেখানে এসব এলাকায় রাখা হচ্ছে রাসায়নিক দ্রব্য।

২০১০ সালে নিমতলীতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকা থেকে প্রাণঘাতী রাসায়নিক পদার্থের কারখানা আর গুদামগুলো সরিয়ে নেওয়ার দাবি উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বেশ কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল পরিকল্পিতভাবে রাসায়নিক শিল্পজোন গড়ে তুলে পুরান ঢাকার সব রাসায়নিক গুদাম সরিয়ে নেওয়া এবং দাহ্য রাসায়নিক দ্রব্য আনা-নেওয়া বন্ধসহ সেখানে নিরাপদ পরিবেশ গড়ে তোলা। পরিতাপের বিষয় হলো, এত বছরেও এখনো সরেনি একটি কারখানাও। উল্টো, সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতার সুযোগে অবৈধ রাসায়নিকের ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা বাড়িয়েই চলেছেন দিনের পর দিন।

অপরদিকে এমনও ঘটেছে যে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন ঠিকানায় ব্যবসার অনুমতি নিয়ে অনেকেই পুরান ঢাকার ভেতরেই রাসায়নিকের মজুত ও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব কাজকে নির্বিঘ্ন করতে তাঁরা স্থানীয় প্রভাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক প্রভাবকেও কাজে লাগাচ্ছেন। তা ছাড়া, এই এলাকার রাসায়নিক ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকেই রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত যেমন কার্যকর হচ্ছে না, তেমনি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও তাঁদের সমীহ করে চলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবনের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় নিলে আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক কারখানা আর গুদামগুলো অচিরেই স্থানান্তরের কোনো বিকল্প নেই।

নগর-পরিকল্পনাবিদেরা ঢাকার নিরাপত্তা বিধান সহজ করতে ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকা আলাদা করতে বলছেন। তাই আরেক দফা বড় বিপর্যয়ের আগে নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দিকনির্দেশনাগুলো দিয়েছিলেন, দ্রুত রাসায়নিকপল্লি চালু করার মাধ্যমে সেগুলো বাস্তবায়ন করার কোনো বিকল্প নেই। কারণ, একটি অপ্রত্যাশিত ও অস্বাভাবিক মৃত্যুর দায়ভারও রাষ্ট্র এড়াতে পারে না।

লেখক: মর্তুজা হাসান সৈকত কলামিস্ট

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ