একবার সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে কিছু রাজনৈতিক কর্মী আমার অফিসে এসেছিলেন। রাজনৈতিক কর্মীরা তখন চলতি রাজনীতির কথা বলছিলেন। একপর্যায়ে সিরাজুল আলম খান হুংকার দিয়ে বললেন, ‘আমি রাজনীতি করি না। কোনো তাত্ত্বিক কথা হলে বলো।’
কথাটা সত্যি। তিনি ষাটের দশকের গোড়া থেকেই রাজনৈতিক তত্ত্বের কথা বলেছেন। সেই তত্ত্ব নিয়ে দল তৈরি হয়েছে, তারপর যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। প্লেটো, অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস, কার্ল মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস—কেউ রাজনীতি করেননি। কিন্তু রাজনৈতিক তত্ত্ব দিয়েছেন। এমন অসংখ্য তাত্ত্বিক আমাদের রাজনীতির ইতিহাসে রয়ে গেছেন। তার মানে দাঁড়ায়, জ্ঞানীরা রাজনীতি করেন না, তত্ত্ব দিয়ে থাকেন। ওই সব জ্ঞানী যদি রাজনীতি করতেন, তাহলে কী হতো? এটা ভাববার বিষয়।
জ্ঞানী এবং রাজনীতি করেছেন এমন মানুষও আছে। যেমন: লেনিন, মাও সে-তুং, হো চি মিন। তাঁরা রাজনৈতিক তত্ত্বকে বিশ্লেষণ করেছেন এবং কিছু মৌলিক ভাবনাও সামনে নিয়ে এসেছেন। সেই মৌলিক ভাবনায় সমাজে কিছু পরিবর্তনও হয়েছে। পরিবর্তনটা অধীত জ্ঞানের জন্য নয়, কিছু মৌলিক চিন্তার জন্য। এই মৌলিক চিন্তাগুলো আসে মানুষের সঙ্গে নিবিড় ভাবনার কারণে, মানুষকে বোঝার কারণে। যতীন সরকার তাঁর বইয়ে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন: কোনো এক জায়গায় কিছু লোক জড়ো হয়ে কী যেন দেখছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, কয়েকজন লোক মাছ ধরছে আর অনেক মানুষ তা-ই দেখছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘ওরা তো মাছ ধরছে, আপনারা কী করছেন?’ একজন বয়োবৃদ্ধ বললেন, ‘আমরা দার্শনিক।’ এই দার্শনিক দর্শক থেকে নেওয়া, দর্শনবিদ্যা নয়। নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষেরা এভাবেই প্রকাশ করে। আসলেই বিষয়টা তা-ই। দেখতে দেখতে মানুষ যে জ্ঞান অর্জন করে বা নতুন ভাবনার সৃষ্টি হয়, সেটাও একধরনের দার্শনিক তত্ত্ব। দেখা গেছে, রাজনীতিতে তাঁরাই সফল হন, যাঁদের জ্ঞান সামান্যই। কিন্তু মানুষকে নিয়ে কাজ করতে করতে তাঁরা বিশাল জ্ঞানের অধিকারী হন এবং এই জ্ঞান তাঁরা কাজে লাগাতে পারেন। আমাদের দেশের বাম দলগুলোর সম্ভবত এখানেই সংকট। অধীত জ্ঞান নিয়ে তারা নামে, জনগণের জন্য কাজ করতে গিয়ে তারা দ্রুত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। একটা সত্য ঘটনা বলি। মফস্বল শহরে কোনো এক বাম-সমর্থকের নিরীহ ভাইকে একদিন পুলিশ ধরে নিয়ে গেল। ওই সমর্থক বাম নেতার কাছে আসেন এবং বলেন, ‘আমার ছোট ভাইকে ধরে নিয়ে গেছে, সে একেবারেই নিরীহ। ওকে তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে আনতে হবে, তা না হলে কোর্টে চালান দিলে অনেক ঝামেলা।’ বাম নেতা খুব গুরুত্বের সঙ্গে তাঁর দিকে তাকালেন, গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তাই তো! কিন্তু পুলিশ তো রাষ্ট্রের শোষক শ্রেণির আজ্ঞাবহ। এ ধরনের একটি শ্রেণিবিভক্ত সমাজে তোমার ভাই পুলিশের নজরে এসেছে। শ্রেণিসংগ্রামের অন্তর্ভুক্ত এ ঘটনা। এখন থানায় গিয়ে তো কোনো লাভ হবে না; বরং পুলিশের নির্যাতনের ওপর থেকে আমরা নিজেদের একটু গুছিয়ে নিয়ে পরশু দিন এলাকায় একটা মানববন্ধন করি। আমি পার্টির নেতাদের সঙ্গে কথা বলছি, মানববন্ধনে যাতে বিপুলসংখ্যক নিপীড়িত মানুষকে একত্র করা যায়।’ সমর্থক হতাশ হয়ে ছোটেন ডানপন্থী এক নেতার কাছে। ডানপন্থী নেতা তখন খুব ব্যস্ত, উত্তেজিত হয়ে মোবাইল ফোনে কাকে যেন বকছেন। ইশারায় সমর্থককে বসতে বললেন। এর মধ্যেই আবার লোকজন বাড়তে থাকে। কেউ সিগারেটের প্যাকেট দিচ্ছে, কেউ চা নিয়ে আসছে। ফোনটা শেষ করে বললেন, ‘তুমি যেন কে?’ সমর্থক বললেন, ‘আমি এই পাড়ায় থাকি, জলিল মেম্বারের পাশের বাড়ি।’ নেতা বললেন, ‘ওহ্।’ তিনি একটু সময় নিয়ে কী যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, ‘কী বলবে বলো।’ সমর্থক তাঁর ভাইয়ের গ্রেপ্তারের কথা বলার পর নেতা বললেন, ‘টাকা আছে?’ সমর্থক বললেন, ‘কিছু আছে।’ নেতা বললেন, ‘চলো একটা রিকশা ডাকো।’ তাঁরা সরাসরি থানায় এলেন। থানায় ঢুকতেই হাজতে সমর্থকের ছোট ভাইয়ের মুখটি দেখা গেল। নেতাসহ সমর্থক ওসির ঘরে ঢুকলেন। প্রথমেই উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করলেন, ‘আপনাদের পুলিশের অত্যাচারে আমাদের কর্মীরা বাঁচতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। যখন খুশি যাঁকে-তাঁকে ধরে আনছেন আপনারা।’ ওসি সাহেব বললেন, ‘শান্ত হোন। বসেন, চা খান। তারপর বলেন কী ঘটনা।’ সমর্থক বলতে শুরু করলেন, ‘গতকাল বিকেলে আমার ভাই খেলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ পুলিশ এসে রেড করেছে এবং অনেকের সঙ্গে আমার ভাইকেও ধরে এনেছে। ও একেবারেই নিরীহ। কারও সাতে-পাঁচে নেই।’ সমর্থকের কথা শেষ করতে না দিয়ে নেতা বললেন, ‘এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে এসো। তারপর বাইরে অপেক্ষা কর।’ দ্রুত সিগারেট এনে দেওয়ার পর আবারও নেতা বললেন, ‘বাইরে দাঁড়াও।’ বেশ কিছুক্ষণ পর নেতা বেরিয়ে আসেন এবং দেখা যায় একজন পুলিশ কনস্টেবল গিয়ে তাঁর ভাইকে বের করে নিয়ে এসেছে। নেতা বললেন, ‘তোমার ভাইকে নিয়ে যাও, বিকেলে অফিসে এসো, কিছু খরচাপাতি আছে।’
কিছু খরচাপাতি দিতে হয়েছিল, কিন্তু ভাইটি তো রক্ষা পেল। সমর্থক আর বাম সমর্থক থাকলেন না। জ্ঞান ও নৈতিকতা দুই-ই পরাজিত হলো। অধিকাংশ মানুষ তাঁর নিত্যনৈমিত্তিকতার কাছে বন্দী। তাঁর খাওয়া-দাওয়া, অসুখ-বিসুখ, সন্তানসন্ততি, বাবা-মা, ভাই-বোনের নিরাপত্তা—এসবের একটা তাৎক্ষণিক সমাধান চান। তার জন্য সার্বক্ষণিক যেকোনো স্তরের নেতাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। জীবনে কোনো একটি কঠিন মুহূর্তে বিপদগ্রস্ত কোনো মানুষ নৈতিকতার কথা শুনতে চায় না, চায় দ্রুত সমাধান।
ষাটের দশকে বাম দলগুলো চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম নিয়ে খুবই ব্যস্ত ছিল। আর ডান দলগুলো তখন জাতীয় সংগ্রামকে সামনে নিয়ে এসেছে, জীবন-মরণ আন্দোলন গড়ে তুলেছে। যার ফলে দেশ স্বাধীন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে বাম দলগুলোর অধিকাংশই ব্যাপক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে। এত কিছু করা সত্ত্বেও ক্রমেই বাম দলগুলোর শক্তি ক্ষয় হতে থাকে। শক্তি ক্ষয় হতে হতে তারা আবার বর্জনের নীতি গ্রহণ করেছে। মানুষ যে পরিবর্তন চায়, সেই পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাও ধরার জন্য কোনো প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেনি। এ কথা সত্যি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে এবং তত্ত্বে বামপন্থীদের জুড়ি নেই। কিন্তু স্থানিক বিবেচনায় ও বদলে যাওয়া জ্ঞানকে গ্রহণ করার জন্য যে মানসিকতা দরকার, তা-ও তৈরি হয়নি। পুঁজিবাদ তার নিজেকে বাঁচানোর জন্য নানা পথ আবিষ্কার করছে। এই পথগুলো মানুষের জীবনের ভাবনাচিন্তা প্রতিনিয়ত বদলে দিচ্ছে। পৃথিবীটাকে নানাভাবে সে উল্টে-পাল্টে দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে জ্ঞান ও গণচরিত্র দুটোই প্রয়োজন। বর্তমানে বিল গেটসের সৌজন্যে সারা পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব প্রায় বিলীন হয়ে ডিজিটালে পৌঁছেছে। ডিজিটালের এই যে বিশ্বব্যাপী অবারিত দ্বার, তাতে মানুষ গণতন্ত্রহীন এবং দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ছে। সত্যকে আবিষ্কার করাই ভবিষ্যতে কঠিন হয়ে পড়বে। এই সময়ে উপযোগী জ্ঞান এবং রাজনীতির পথটা খুঁজে বের করতে হবে। কাজটি কঠিন মনে হলেও আন্তরিকতার মূল্য এখনো সমাজে আছে। সমস্যাগুলো আন্তরিকতার সঙ্গে যদি গ্রহণ করা যায়, তাহলে যুগোপযোগী একটা পন্থা খুঁজে পাওয়া যাবে।
সিরাজুল আলম খানের সেদিনের কথা আমার এখনো কানে বাজে। কারণ, তিনি তাঁর তত্ত্বের একটা পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। সে পরীক্ষা শেষ হয়েছে এবং ফলাফলও আমরা পেয়েছি। তিনি তত্ত্বকে শুধু জ্ঞানের জায়গায় রাখেননি, প্রয়োগও করেছেন। কিন্তু সবটাই ছিল গণবিচ্ছিন্ন এবং যুক্তি দিয়ে নয়, অস্ত্রের প্রবল ব্যবহার করা হয়েছিল।
লেখক: মামুনুর রশীদ,নাট্যব্যক্তিত্ব