ঋণখেলাপি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে আলোচনায় আসা পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারী গ্রামের ৩৭ জন কৃষক মূলত ঋণের সুদের ফাঁদে জড়িয়েছেন। অনেকে ঋণের টাকা সুদ-আসলে পরিশোধ করলেও ব্যাংকের সুদের চক্রবৃদ্ধির জাল কীভাবে তাঁদের জড়িয়ে ফেলেছে, তা টের পাননি তাঁরা। আর তাই ব্যাংকের মামলায় জেলে যেতে হয়েছে ১২ কৃষককে। মাত্র ৪০০ টাকার জন্যও জেল খেটেছেন তাঁদের কেউ কেউ।
বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের গঠিত তিন সদস্যের কমিটির সদস্যা গতকাল সোমবার দুপুরে ভাড়ইমারী গ্রামে কৃষকদের ঋণখেলাপির বিষয়টির তদন্তে যান। তাঁরা কৃষকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করেন। সেখানে এ তথ্য উঠে আসে।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা কাগজপত্র ঘেঁটে জানতে পারেন, ঋণের সুদের হার চক্রবৃদ্ধি হয়েছে কয়েক গুণ। আবার ঋণের টাকা সম্পূর্ণ পরিশোধ না করায় কৃষকদের ২ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ পর্যন্ত সুদ ধরেছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কৃষকদের কেউ কেউ সম্পূর্ণ টাকা সুদসহ ফেরত দিয়েছেন। কিন্তু তাঁদের নামের পাশে গত কয়েক বছরে সুদের টাকা বেড়েছে চক্রবৃদ্ধি হারে, যে সুদের কথা জানেনই না তাঁরা।
কৃষক মজনু প্রামাণিক জানান, তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন ৪০ হাজার টাকা। সুদ-আসলে মোট পরিশোধ করেছেন ৫৫ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ এখনো তাঁর নামে সুদের বকেয়া দেখানো হয়েছে ৪ হাজার ৫০০ টাকা। ব্যাংক তাঁকে কখনো বকেয়ার নোটিশ দেয়নি।
একই গ্রামের ভুক্তভোগী আতিয়ার রহমান বলেন, তাঁর নামে বকেয়া মাত্র ৪০০ টাকা। তাঁর দাবি, তিনি এ টাকার কথা জানেন না। কখনো ব্যাংকের মাঠকর্মীরা বা কর্মকর্তারা বলেননি। তিনি জানতেন তাঁর কোনো বকেয়া নেই। অথচ এই মাত্র ৪০০ টাকার জন্য তাঁকে জেল খাটতে হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের ডিজিএম (পরিদর্শন) আহসানুল গণি বলেন, ‘এখানে ব্যাংকের নিয়মে যেটা ধার্য সেই টাকা কৃষকেরা পরিশোধ না করায় মামলা হয়েছে। ৪০ জন কৃষক ঋণ নিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে তিনজন সুদসহ টাকা পরিশোধ করায় তাঁদের নামে কোনো মামলা হয়নি। আমরা সব যাচাই-বাছাই করে তথ্য-প্রমাণসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতিবেদন জমা দেব। আর মামলার আগে কৃষকদের একাধিকবার নোটিশের মাধ্যমে জানানো হয়েছে।’
উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে ঈশ্বরদী উপজেলার ভাড়ইমারী গ্রামের ৪০ জন কৃষক বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক থেকে দলগত ঋণ হিসেবে ১৬ লাখ টাকা নেন। এর মধ্যে কেউ ২৫ হাজার, কেউ ৪০ হাজার টাকা করে ঋণ পান। দীর্ঘদিনেও সেই ঋণ ও সুদের টাকা পরিশোধ না করায় ২০২১ সালে ৩৭ জন কৃষকের নামে মামলা করে ব্যাংকটি। সম্প্রতি আদালত তাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে গত ২৫ নভেম্বর ১২ জন কৃষককে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ।
বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার সৃষ্টি হয়। গত ২৭ নভেম্বর পাবনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-২-এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক শামসুজ্জামান গ্রেপ্তার ১২ কৃষকসহ ৩৭ জন কৃষকের জামিন মঞ্জুর করেন। পরে ২৯ নভেম্বর ৩৭ কৃষক তাঁদের সুদসহ ঋণের বাকি টাকা ও মামলা প্রত্যাহারের জন্য ব্যাংকের কাছে দাবি জানান। এ ঘটনা তদন্তে গত ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের ডিজিএম (পরিদর্শন) আহসানুল গণিকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।