হোম > ছাপা সংস্করণ

শুভবুদ্ধি আসুক বিএনপিতে

মোনায়েম সরকার

১২ জুলাই রাজধানীতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুটি সমাবেশ হয়েছে। সেদিনই সন্ধ্যায় এই নিবন্ধ লিখতে বসে যেসব খবর পেলাম, তাতে বলতে হয় সমাবেশ দুটি স্বল্প দূরত্বে অনুষ্ঠিত হলেও দুই দলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে কোনো রকম সংঘাত হয়নি। অনেকে আশঙ্কা করছিলেন, এদিন রাজধানীতে একটা সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। এ জন্য মানুষের মধ্যে একধরনের আতঙ্ক ছিল। যান চলাচল কমে গিয়েছিল রাজধানীতে। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ভালোয় ভালোয় সম্পন্ন হওয়ায় সবাই হাঁফ ছেড়েছেন। ব্যক্তিগতভাবে আমিও স্বস্তি বোধ করছি। পুলিশ উভয় পক্ষকে একই রকম শর্ত দিয়েছিল, যাতে সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়। আমাদের মতো দেশে সব শর্ত পালন করা না গেলেও সদিচ্ছা থাকলে যে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করা যায়, তার প্রমাণ পাওয়া গেল। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে মানুষে সয়লাব করে দেওয়া সমাবেশের যে আওয়াজ তোলা হয়েছিল, তেমন কিছু বাস্তবে দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশেও দলীয় কর্মীসহ জনসমাগম কম হয়নি। তারাও পুলিশের শর্ত মেনে সমাবেশ করে উদাহরণ তৈরি করল।

বিএনপির সমাবেশ থেকে এদিন সরকার পতনের এক দফা ঘোষণা করে পদযাত্রার দিনক্ষণ জানানো হয়েছে। নিজেদের ভাষায় সরকারকে অভিযুক্ত করে তারা বলেছে, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এটা পরিষ্কার, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদল ও যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারির সফরের মধ্যে তারা রাজধানীতে একটি বড় সমাবেশ করে পশ্চিমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও পাল্টা সমাবেশ করে নিজ শক্তি ও জনসমর্থনের জানান দিতে চেয়েছে। বিএনপির দাবির জবাবে এই সমাবেশ থেকে বলা হয়েছে, তাদেরও এক দফা। সেটা হলো, আগামী নির্বাচন হবে যথাসময়ে এবং সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে।

প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্ব সম্পর্কে ওই সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক যা বলেছেন, তার সঙ্গে দেশের বেশির ভাগ মানুষই একমত হবে। শেখ হাসিনা সৎ, দক্ষ, দূরদর্শী এবং দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে তার জুড়ি নেই। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের বিষয়ে বিশেষভাবে আগ্রহী পশ্চিমা মহলসহ সবাইকে তিনি কথা দিয়েছেন, আগামী নির্বাচন অবশ্যই সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যত খুশি পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে নির্বাচন দেখার কথাও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে। আর নির্বাচন করবে তো নির্বাচন কমিশন। সরকার তাকে সব ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত। ইতিমধ্যে স্থানীয় সরকারের যেসব নির্বাচন হয়েছে, তাতে বিএনপি অংশ না নিলেও প্রতিদ্বন্দ্বীর অভাব হয়নি। নির্বাচনে বড় অনিয়মও হয়নি। ভোট প্রদানের হারও কম নয়। বিএনপির স্থানীয় পর্যায়ের অনেক নেতা–কর্মীও এতে অংশ নিয়েছেন এবং জয়যুক্ত হয়েছেন। তাদের পক্ষের ভোটাররাও ভোট দিতে গেছেন। সুতরাং ভবিষ্যতে বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবিতে অটল থেকে জাতীয় নির্বাচন বর্জন করলেই সরকারের জন্য খুব প্রতিকূল পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, এটা বলা যায় না।

রাজনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে অন্যায় দাবিও আদায় করা যায় সরকারের ওপর আন্দোলনের চাপ সৃষ্টি করা গেলে। বিএনপি ও তার সহযাত্রীদের চিন্তা করে দেখতে হবে, সে ধরনের আন্দোলন গড়ে তোলার মতো শক্তি তাদের আছে কি না। সরকার পতনের আওয়াজ তারা এর আগেও তুলেছে। দিনক্ষণ ঠিক করেও কার্যকর আন্দোলন গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে। গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের কথা আমাদের সবার মনে আছে। রাজধানীতে সারা দেশ থেকে বিপুলসংখ্যক কর্মী-সমর্থক এনে সেদিনই তারা রাস্তায় বসে যাবে হেফাজত স্টাইলে—এমন একটি পরিকল্পনা ছিল বলে জানা যায়। সরকার স্বভাবতই তেমন অরাজকতা সৃষ্টি হতে দেয়নি। কোনো সরকারই রাজধানীর বুকে এমন কিছু ঘটতে দিতে পারে না। তবে বিকল্প স্থানে বিএনপির সমাবেশ যাতে শান্তিপূর্ণভাবে হতে পারে, তার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল। সত্যি বলতে, সেদিন সরকারের জন্য বিব্রতকর কিছুই ঘটেনি।

তার আগে থেকেই অবশ্য বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গোষ্ঠীর। তাদের অন্যায্য শর্ত মেনে না চলা শেখ হাসিনার সরকারকে পশ্চিমাদেরও অপছন্দ। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি সে কথা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকেও খোলাখুলি বলেছেন। জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েও সত্য উচ্চারণে দ্বিধা করেননি। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নিতান্ত নিজেদের স্বার্থে সরকারকে বিব্রত করে চলেছে কিছু অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ নিয়ে। র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশের জন্য পৃথক ভিসা নীতি তারা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি বিষয়ে বিএনপি ও তার মিত্রদের মতো করে তারা বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের শর্ত হিসেবে তারা যে ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, তাতে সরকার সেভাবে চিন্তিত নয়। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারও আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু করতে চায়। এই নির্বাচনে বিএনপির মতো বড় দল অংশ নিক, এটা তাদেরও চাওয়া। এই নির্বাচনী প্রক্রিয়া নস্যাৎ করতে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলে বিএনপি বরং ভিসা নীতিতে পড়বে—এমনটাই মনে করছে সরকার। সুতরাং পশ্চিমাদের দিক দিয়ে পরিস্থিতি সরকারের সম্পূর্ণ প্রতিকূলে, সেটাও বলা যাবে না।

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ইতিমধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতিও শুরু করে দিয়েছে। বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে, জনসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে আগামী নির্বাচনেও তারা জয়যুক্ত হতে চাইছে। বাংলাদেশের মতো দেশে উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য সরকারের ধারাবাহিকতা প্রয়োজন—এ কথা প্রধানমন্ত্রীও বলেন। ক্ষমতাসীন দল রয়েছে তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। নিজস্ব চ্যানেলে খোঁজখবর নিয়ে তিনি উপযুক্ত প্রার্থী মনোনয়নে এগিয়ে যাবেন, এটাই প্রত্যাশা। এ অবস্থায় বিএনপি প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের যে স্বপ্ন দেখছে, তা থেকে বাস্তবতা অনেক দূরে।

তা ছাড়া, কঠোর আন্দোলন গড়ে তোলার মতো নেতৃত্ব বিএনপির নেই। দলের মধ্যে রয়েছে অনৈক্য ও সমন্বয়হীনতা। বিএনপির সঙ্গী সংগঠনগুলোর শক্তি-সামর্থ্যও আস্থা জাগানোর মতো নয়। তরুণদের নিয়ে যে একটি মোটামুটি শক্তিশালী গ্রুপ গড়ে উঠেছিল, তাতেও বিভিন্ন অনৈতিক প্রশ্নে দেখা দিয়েছে বিভক্তি। সেখানে অগ্রহণযোগ্য বিদেশি শক্তির সঙ্গে তাদের ওঠাবসার অভিযোগ খোদ বিরোধী দলের সমর্থকদেরও হতাশ করবে। অতীতের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডের জন্যও বিএনপির ওপর মানুষের আস্থার অভাব রয়েছে। তারা সরকার পতনের ডাক দিলেই মানুষ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে, পরিস্থিতি মোটেও তেমন নয়। দেশে যে অর্থনৈতিকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমস্যা নেই, তা তো নয়। একটি বড় জনগোষ্ঠী কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে, এটাও অস্বীকার করা যাবে না। অনেক দেশেই একই অবস্থা। তা সত্ত্বেও বিএনপির ডাকে মানুষ রাস্তায় নেমে আসছে না, এটা হলো বাস্তবতা। আগামী কয়েক মাসের মধ্যে এই বাস্তবতা বদলে যাবে বলেও কি আশা করা যায়? যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্ররা একটি সফল সরকারকে বিএনপির ইচ্ছাপূরণের জন্য ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেবে—এমন প্রত্যাশাও শিশুসুলভ। আজকের দুনিয়ায় কেউ বাইরে থেকে এসে একটি শক্তিশালী সরকারের পতন ঘটিয়ে দিতে পারে না। বিএনপিকে ভেবে দেখতে হবে, বাংলাদেশ ইমরান খান শাসিত পাকিস্তানের মতো পরিস্থিতিতে নেই। এখানকার সবকিছুই আলাদা, তা নিশ্চয় বিএনপি নেতাদের বুঝিয়ে বলতে হবে না।

পশ্চিমারা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন দেখতে চায়, তাতে কারও আপত্তি নেই। তাদের নজরদারির কারণে আগামী নির্বাচন অপেক্ষাকৃত ভালো পরিবেশে অনুষ্ঠিত হবে, এটাও স্বাভাবিকভাবে আশা করা যায়। কিন্তু তারা কি কখনো বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানাবে? সংগত কারণেই অসাংবিধানিক কিছুর দাবি তারা জানাবে না। সে কারণে বিএনপিকেও এমন অগ্রহণযোগ্য দাবি থেকে দ্রুত সরে এসে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার মনোভাব প্রকাশ করতে হবে। সেটা তাদের জন্যও মঙ্গলজনক।

বিএনপির মতো একটি দল আর কত দিন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বাইরে থাকবে? এই নীতি অব্যাহত রাখলে তাদের মধ্যে বিভক্তিও কি দেখা দেবে না? স্থানীয় নির্বাচনে তারা অনেক নেতা-কর্মীকে ‘দলীয় শৃঙ্খলায়’ ধরে রাখতে পারেনি। জাতীয় নির্বাচনে সেই প্রবণতা আরও বাড়বে। তার বদলে বিএনপি পারে সংবিধানের আওতায় কীভাবে আরও ভালোভাবে নির্বাচনটি করা যায়, সে বিষয়ে কথাবার্তা শুরু করতে।

গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে তারা রাষ্ট্র সংস্কারের প্রস্তাবও এর আগে তুলে ধরেছে। বিএনপি কতটা সংস্কারে বিশ্বাসী, সে বিষয়ে কিন্তু প্রশ্ন রয়েছে। গণতন্ত্রের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাবোধও প্রশ্নবিদ্ধ। তার পরও দেশের একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে অযাচিত দাবি প্রত্যাহার করে এগিয়ে এলে নির্বাচনটিও অধিকতর গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ হয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এগিয়ে যায়। এটাই কি দিন শেষে প্রত্যাশিত নয়?

মোনায়েম সরকার, রাজনীতিক, লেখক; মহাপরিচালক, বিএফডিআর

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ