আসছে ঈদুল আজহা। শহরে-গঞ্জে জমে উঠছে কোরবানির হাট। এই ঈদ ঘিরে বাংলাদেশের বহু খামারি স্বপ্ন বুনেছেন। বছরব্যাপী গরু, ছাগল, ভেড়াসহ কোরবানির উপযোগী প্রাণী লালনপালনের পর এখন সময় এসেছে বিক্রির। দেশের প্রাণিসম্পদের খামারগুলোতে চলছে শেষ মুহূর্তের পরিচর্যা, চলছে বাণিজ্যিক হিসাব-নিকাশ। কেননা কয়েক বছরে অন্য সব শিল্পোদ্যোগের মতো গরু মোটাতাজাকরণও একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এ খাতে লাভ বুঝে গোটা দেশেই সম্প্রসারিত হচ্ছে প্রাণিসম্পদের খামার। এসব খামারেই এবার প্রস্তুত হয়েছে কোরবানির উপযোগী ১ কোটি ২৫ লাখের অধিক গরু-ছাগল। গত বছরের কোরবানির হিসাব বলছে, ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার প্রাণী কোরবানি হয়েছিল সারা দেশে। সেই হিসাবে কোরবানির চাহিদা অনুযায়ী এবারও যথেষ্ট প্রস্তুতি আছে। এই প্রস্তুতির পেছনে রয়েছে দেশে গড়ে ওঠা ছোট-বড় অসংখ্য খামার; বিশেষ করে কোরবানি ঘিরে গরু মোটাতাজা করার ছোট ও মাঝারি আকারের খামারগুলোকে বলা যায় কুটিরশিল্প।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় বেশ কিছু গবাদিপশুর খামার চোখে পড়ে। খামারগুলো গড়ে তুলেছেন শহরের শিক্ষিত ও আধুনিক মনমানসিকতার তরুণেরা। শুধু কোরবানিই নয়, বছরব্যাপী মাংসের চাহিদা মাথায় রেখে প্রাণী লালনপালনের এ বাণিজ্য। এই উদ্যোক্তারা যেমন স্মার্ট, তেমনি স্মার্ট তাঁদের খামার ব্যবস্থাপনা। খামারগুলো বেশ বড় এবং গোছানো। তাঁদের সংগ্রহে আছে নানান জাতের ও রঙের গরু।
শুধু গরু নয়, নানান জাতের মহিষ থেকে শুরু করে দুম্বা, ভেড়া কিংবা খাসি—সবকিছুর চাহিদা এখনকার বাজারে। সেই চাহিদার ভিত্তিতেই এখানকার সংগ্রহ বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ।
কোরবানি ঘিরে এমন খামারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, এক দশকে দেশে পশুপালন খাতে বিনিয়োগ বেড়েছে। বাজারে বাণিজ্যিকভাবে দুধ ও মাংস সরবরাহের ব্যবসায় নেমেছেন নতুন অনেক খামারি। এতে ১০ বছরে দুধ ও মাংসের উৎপাদন বেড়েছে ১৫০ শতাংশের বেশি।
দেশের গবাদিপশু দিয়েই কোরবানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। অথচ বছর পাঁচেক আগেও এ চিত্রটা ছিল অন্য রকম। প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে বৈধ-অবৈধ নানা পথেই আমদানি করা হতো কোরবানির গরু।
কিন্তু বর্তমান চিত্রটা সমৃদ্ধির, স্বয়ংসম্পূর্ণতার; যা তৈরি হয়েছে তরুণ শিক্ষিত উদ্যোক্তাদের হাতে। তারাই পাল্টে দিচ্ছে দিন। পাঠক, আপনাদের মনে থাকতে পারে বছরখানেক আগে তুলে ধরেছিলাম নারায়ণগঞ্জের লুৎফর রহমানের আধুনিক খামার ব্যবস্থাপনা। যেখান থেকে অনলাইনেই বিক্রি হয়ে যায় কোরবানির অধিকাংশ প্রাণী।
মনে পড়ছে করোনার সময় সরকার-সংশ্লিষ্টরা যখন ঘোষণা করলেন স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে পবিত্র ঈদুল আজহা সামনে রেখে বরাবরের মতোই কোরবানির পশুর হাট বসানো হবে, তখন আমি করোনার সার্বিক পরিস্থিতি উল্লেখ করে তাঁদের বিকল্প পথ খোঁজার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। চ্যানেল আইয়ের নিয়মিত অনুষ্ঠান ‘টু দ্য পয়েন্ট’-এর এক আলোচনায় বলেছিলাম, কোরবানির পশুর অনলাইন বাজারব্যবস্থা শক্তিশালী ও কার্যকরের জন্য। প্রতিটি ইউনিয়নেই ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার রয়েছে।
সরকার চাইলে এই জনশক্তি ব্যবহার করে সহজেই কোরবানির পশুর অনলাইন মার্কেট চালু করতে পারে। এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলাম আইসিটি-বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামের সঙ্গে। তাঁরা তখন বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেন। সে বছর অনলাইন কোরবানির বাজার বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। পরে অনলাইনই হয়ে উঠেছে কেনাবেচার দারুণ মাধ্যম। দিনে দিনে পাল্টেছে বাজারের ধারণা। সেই সঙ্গে পাল্টেছে গরু বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়াও। কোরবানি সামনে রেখে প্রতিবছরই ছোট-বড় অসংখ্য গরুর খামার গড়ে উঠছে। খামার বাড়ছে। পরিবর্তন এসেছে ভোক্তা ও খামারির ভাবনায়ও।
ভোক্তা ও ক্রেতার মধ্যে গরুর মান সম্পর্কে ইতিবাচক সচেতনতা তৈরি হয়েছে। এখন স্টেরয়েড বা ক্ষতিকর রাসায়নিক খাইয়ে গরু মোটাতাজাকরণের ব্যাপারটি খুব বেশি নেই। শিক্ষিত মানুষের খামার উদ্যোগে যুক্ত হওয়া, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও গণমাধ্যমের তুমুল তৎপরতায় খামারি, ভোক্তা, ব্যবসায়ী সবাই গরু মোটাতাজাকরণের ইতিবাচক ধারণাটি পেয়ে গেছেন। অথচ কয়েক বছর আগেও দেখেছি, শুধু টাকার লোভে অসাধু পন্থা অবলম্বন করতে গিয়ে বহু খামারি ও ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এখন স্টেরয়েড খাওয়ানো গরুর স্বভাব দেখে সব ক্রেতাই চিনতে পারেন। এ জন্য খামারিরাও অধিক সতর্ক হয়ে উঠেছেন। গত কয়েক বছরে দেখেছি কোরবানির সময় রাসায়নিক প্রয়োগের সন্দেহে যেসব গরু বিক্রি হয়নি, সেগুলোর মধ্যে অনেক গরুই হাটেই মারা গেছে। কারণ রাসায়নিক প্রয়োগের কারণে গরুর শরীরে যে বাড়তি পানি জমে তা একটি নির্দিষ্ট সময় পরে বিষক্রিয়া করে; যা গরুর বেঁচে থাকার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। বিষয়গুলো এখন সচেতন খামারিদের কাছে পরিষ্কার। যাঁরা বেশি বিনিয়োগ করে খামার গড়ছেন, তাঁদের কাছে বিষয়টি বেশি চ্যালেঞ্জিং। তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন বিশুদ্ধ খাদ্য দিয়ে গরু মোটাতাজা করতে। টেলিভিশন প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে এমনই কয়েকজন উদ্যোক্তার দেখা পেলাম কয়েক দিনে। যেমন ঢাকার অভিজাত এলাকার মানুষের চাহিদা বিবেচনায় প্রকৌশলী মকবুল হোসেন গড়েছেন গরুর খামার। তিনি শুরু করেছিলেন গাভি পালন দিয়ে। পরে যুক্ত করেন বিশুদ্ধ উপায়ে দেশি পদ্ধতিতে মাংসের গরু পালন। বললেন, অনলাইনেই বেচা হয়ে যায় সব। লাইভ ওয়েটে কেজি দরে বিক্রি করেন। দেখলাম গরুগুলো বেশ তাজা এবং চঞ্চল।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, এবার পবিত্র ঈদুল আজহায় দেশে কোরবানির জন্য প্রাণীর চাহিদা প্রায় ১ কোটি ৪ লাখ। এর বিপরীতে কোরবানির জন্য প্রস্তুত ১ কোটি ২৫ লাখ ৩৬ হাজার। এই হিসাবে এবার চাহিদার চেয়ে বেশি আছে প্রায় সাড়ে ২১ লাখ গরু-ছাগল।
চাহিদার চেয়ে জোগান বেশি থাকায় প্রভাব পড়েছে কোরবানির হাটগুলোতে। সার্বিকভাবেই বাজার পরিস্থিতি অনেক ক্রেতাসাধারণের হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফলে উৎপাদন বাড়লেও করোনা এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতি বিরূপ হওয়ায় কয়েক বছরে দেশে কোরবানির সংখ্যা কমেছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে পবিত্র ঈদুল আজহায় ১ কোটি ৬ লাখের বেশি পশু কোরবানি হয়। ২০২২ সালে ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে। ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার পশু কম কোরবানি হয়েছে। মূলত এ দুই কারণে দেশে পশু কোরবানি কমেছে। অর্থনৈতিক সংকটের কারণে মানুষের সক্ষমতা কমেছে। অন্যদিকে বেড়েছে গবাদিপশুর দাম।
ক্রমেই বড় হয়ে ওঠা গবাদিপশু লালন-পালনের এ শিল্পটি যেন নিজস্ব গতিতে এগিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি পুষ্টির চাহিদা পূরণে মাংসের দাম যেন সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে থাকে। পরস্পর বিপরীতধর্মী দুই চাহিদাকে একরেখায় আনতে নিতে হবে নীতিগত সিদ্ধান্ত।
পুরোদমে চলছে কোরবানির হাটের বেচাকেনা। হাট থেকে নিরাপদে সংগ্রহ করুন আপনার কোরবানির প্রাণী। কোরবানির যথাযথ নিয়ম মেনে চলুন। কোরবানির পর পরিচ্ছন্ন রাখুন আপনার পরিবেশ। সবাইকে পবিত্র ঈদুল আজহার শুভেচ্ছা। অগ্রিম ঈদ মোবারক।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান, চ্যানেল আই