প্যারিস স্কুল অব ইকোনমিকসের ‘বৈশ্বিক অসমতা’ প্রতিবেদনের তথ্য জানাচ্ছে যে বাংলাদেশের ১ শতাংশ মানুষ এখন দেশটির ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় সিকিভাগ সম্পদের মালিক। আর সম্পদ, সম্পদের মালিকানা, এর প্রবৃদ্ধির হার ও এতদসংক্রান্ত গবেষণার ফলাফল থেকে এ তথ্যও বেরিয়ে আসছে যে ওই সিকিভাগ অতিসম্পদধারী ব্যক্তিদের সম্পদের ক্ষেত্রেই প্রবৃদ্ধির হার সর্বাধিক এবং ওই প্রবৃদ্ধির জোরেই বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এক দশকের বেশি সময় ধরে অনেকটাই চমক দেখিয়ে চলেছে। অন্যদিকে সম্পদের ওপর নিম্নবিত্ত মানুষের মালিকানার পরিসর সংকুচিত হতে হতে ক্রমেই তা এমন রূপ ধারণ করেছে যে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্বের সর্বাধিক সম্পদবৈষম্যপূর্ণ দেশগুলোর তালিকায় একেবারে প্রথম সারিতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ৫১ বছরের অর্জন-অনার্জনের মূল্যায়নে তাই অনিবার্যভাবেই সামনে চলে আসছে এ কথা—যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রাম, আন্দোলন ও যুদ্ধ করে এ দেশ স্বাধীন হলো, স্বাধীনতা-উত্তর সে দেশে বৈষম্যই যদি মূল সমস্যা, তাহলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাটি রক্ষা পেল কোথায়? মানুষ এ প্রশ্নও করতে শুরু করেছে যে কাদের পাপে ও কর্মে দেশে আজ এমন একটি অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি হলো?
সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত কিন্তু সার জবাব হচ্ছে, এ আমাদের সম্মিলিত পাপ ও কর্মের ফল; অর্থাৎ এ অবস্থা আমরা সবাই মিলে তৈরি করেছি।যার মধ্যে রাজনীতিকদের চিন্তার দৈন্য ও ক্ষমতালিপ্সা, আমলাতন্ত্রের জনবিচ্ছিন্নতা ও কৌশলী স্বার্থোদ্ধার, বণিকশ্রেণির লোভ ও লুটেরা মানসিকতা, নাগরিক সমাজের লেজুড়বৃত্তি, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের পলায়নপর মানসিকতা, জনগণের মধ্যকার প্রতিবাদী চেতনার ক্রমবিলুপ্তমানতা ইত্যাদি সবই রয়েছে। তবে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল দায়িত্ব যেহেতু রাজনীতিকদের, সেহেতু তাঁদেরই দায়িত্ব ছিল উপরোল্লিখিত অন্যদের সঠিক পথে পরিচালনা করা। কিন্তু সে দায়িত্ব পালনে রাজনীতিকেরা শুধু ব্যর্থই হননি, নিজেদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য অন্যদেরও ব্যর্থ হতে প্রশ্রয় ও প্ররোচনা দান করেছেন। আর এ অভিযোগ শুধু বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে নয়। এ অনাকাঙ্ক্ষিত অন্যায় কাজগুলো সব দলের, সব রাজনীতিকই করেছেন। ফলে এ দায়ও সবার।
সে যা হোক, এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীনতার গোড়ায় তো এমনটি ছিল না। তাহলে এই ১ শতাংশ লোকের হাতে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ সম্পদ গেল কীভাবে? এ ক্ষেত্রে প্রথম বড় লুটপাটটি হয় স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ‘শত্রু সম্পত্তি’ দখল, পশ্চিম পাকিস্তানিদের ফেলে যাওয়া সম্পদ কুক্ষিগতকরণ, বৈদেশিক ত্রাণ ও রাষ্ট্রীয় অনুদান আত্মসাৎ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। লুটপাটের দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ১৯৭০-এর দশকের শেষ প্রান্তে ও পুরো আশির দশকজুড়ে; বিরাষ্ট্রীকরণের নামে ব্যাংক-বিমাসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানা নামমাত্র মূল্যে পানির দরে রাজনীতিকদের আত্মীয়স্বজন ও ‘সমঝোতার ভিত্তিতে’ গড়ে ওঠা মিত্রদের কাছে হস্তান্তরের মাধ্যমে। তৃতীয় লুটপাটটি শুরু হয় ১৯৯০ দশকের গোড়ায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার সূত্রে বিশ্বব্যাপী দ্রুত বিস্তার লাভকারী মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থনীতিতে অতিউদারীকরণের ধারা প্রবর্তিত হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর চতুর্থ তথা বর্তমান লুটপাটকালের যাত্রা চলতি শতকের দ্বিতীয় দশকের গোড়া থেকে, যা অদ্যাবধি অব্যাহত আছে।
সম্পদ কুক্ষিগতকরণের উল্লিখিত বিভাজনগুলোর দিকে বিশ্লেষণাত্মক সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে তাকালে দেখা যাবে যে রাজনৈতিক কালপর্বের প্রতিটি পর্যায়েই রাজনীতিকেরা দেশকে কখনো জাতীয় স্বার্থের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেননি। দেখেছেন নিজেদের দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থরক্ষার অবস্থান থেকে। যে অবস্থানে ক্ষমতাই হচ্ছে মূল আরাধ্য। আর সে রকম একটি দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই দেশ ও সমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়নের পরিবর্তে তা রূপ নিয়েছে সম্পদ লুটপাটের একটি কৌশল হিসেবে এবং সেই কৌশলকে আশ্রয় নিয়ে লুটেরারা রাষ্ট্রের সম্পদকে শুধু লুণ্ঠনই করেননি, লুণ্ঠিত সম্পদকে রাষ্ট্রীয় সীমার বাইরেও পাচার করে নিয়ে গেছেন। আর পাচার করা সেই অর্থ দিয়ে নিজেদের জন্য বেগমপাড়া ও অন্যত্র আবাস গড়ার পাশাপাশি তাঁরা পুষ্ট হতে সাহায্য করছেন সেসব দেশের অর্থনীতিকে। আর এসবই তাঁরা করেছেন বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে রক্ষিত সাধারণ মানুষের আমানতের অর্থ এবং দেশের অভ্যন্তরের নানা উৎস থেকে ধূর্ততা ও প্রতারণা করে সম্পদ লুটের মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক আমলে ভিনদেশি শাসকদের সমর্থনে ওই দেশীয় বণিকেরা এ দেশ থেকে নানা কৌশলে সম্পদ লুট করে তাঁদের দেশে নিয়ে যেতেন। এখন এ দেশি লুটেরারাই নিজ দেশের সম্পদ লুট করে সাবেক ঔপনিবেশিক শাসকদের দেশসহ অন্যান্য দেশে পৌঁছে দিচ্ছেন। ঔপনিবেশিকতার কী চমৎকার প্রতিস্থাপন!
পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও প্রবণতা দেখে মনে হচ্ছে, সম্পদবৈষম্য বৃদ্ধির এ গতিধারা শিগগিরই শ্লথ হবে না। আর নিম্নবিত্ত সাধারণ মানুষের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে ওই বৈষম্যের লাগাম টেনে ধরার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও মনে হচ্ছে না।রাষ্ট্র বরং উল্টো এমন সব আর্থিক ও অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করছে, যা বৈষম্যকেই ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে চলেছে। ব্যাংকের ঋণনীতি খেলাপিদের পক্ষে। রাষ্ট্রের করনীতি বিত্তবান করপোরেটদের স্বার্থকে পাহারা দিচ্ছে। অসহনীয় মাত্রার বৈদেশিক ঋণ নিয়ে এমন সব উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যেগুলোর প্রকল্প ব্যয়ের সিংহভাগই আত্মস্থ হয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক নব্য বিত্তবানদের দ্বারা।
আবার বিত্তবান তৈরি করার জন্যও কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে, যেগুলোর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সচেতন মহল থেকে বারবার প্রশ্ন তোলা হলেও সেগুলো গ্রহণকে কিছুতেই নিবৃত্ত করা যাচ্ছে না। ভূসম্পত্তিও ক্রমান্বয়ে চলে যাচ্ছে বিত্তবানদের দখলে। অথবা বলা যায়, একশ্রেণির লুটেরা রাষ্ট্রাধীন ভূসম্পত্তি গ্রাস করে রাতারাতি বিত্তবান হয়ে উঠছে।
মোটকথা, রাষ্ট্র এখন বিত্ত ও বিত্তবৈষম্য বৃদ্ধির পক্ষেই শুধু নয়, এর পৃষ্ঠপোষকও। ফলে ২০২২ সালে দেশের ১ শতাংশ মানুষের হাতে ২৪ দশমিক ৬ শতাংশ সম্পদের যে মালিকানা রয়েছে, রাষ্ট্রের বর্তমান নীতিকাঠামো অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে তা আরও বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে বলেই ধারণা করা চলে। তদুপরি বিত্তবানদের ওই পুঁজি ক্রমান্বয়ে আরও শোষণমূলক ও লুণ্ঠনধর্মী হয়ে ওঠার পাশাপাশি রাষ্ট্রের পরিচালন ও কর্তৃত্ব রাজনীতিকদের হাত থেকে ক্রমান্বয়ে ব্যবসায়িক বিত্তের করতলগত হয়ে পড়ার আশঙ্কাই বেশি। কিন্তু তেমনটি যাতে না হয়, সে জন্য ব্যক্তিগত প্রয়োজন ও দলীয় স্বার্থ ভুলে রাজনীতিকদেরই সর্বাগ্রে কর্তব্য হবে বৈষম্য হ্রাসমূলক কর্মসূচির পক্ষে দাঁড়ানো।আর তেমনটি করতে না পারলে অর্জিত স্বাধীনতা মূলত একটি স্বতন্ত্র ভূখণ্ডের পরিচিতিদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, কখনোই একটি মর্যাদাশীল জাতিরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক, শিল্প মন্ত্রণালয়