হোম > ছাপা সংস্করণ

মোদির সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব বাংলাদেশেও

ড. মইনুল ইসলাম

সম্প্রতি ভারতের কর্ণাটকে একজন মুসলিম কলেজ-শিক্ষার্থী তরুণী বোরকা ও হিজাব পরিধানের কারণে বিজেপির গেরুয়াধারী আক্রমণ-উদ্যত সমর্থকদের সামনে পড়ে নাকাল হয়েছেন। ওই চেলা-চামুণ্ডাদের ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিসহকারে অশ্রাব্য গালিগালাজে অতিষ্ঠ হয়ে ওই তরুণীর উপর্যুপরি ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনিতে সোচ্চার প্রতিবাদের ভিডিওটি শুধু ভারতে নয়, সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ভিডিওতে কয়েকজন শিক্ষকের হস্তক্ষেপে ওই তরুণী ঘটনাস্থল থেকে নিরাপদে সরে যেতে পারার দৃশ্যটি দেখা গেলেও এ ঘটনাটি ভারতের সাম্প্রতিককালের ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন ও সংঘাতকে বিশ্বের সামনে নগ্নভাবে উন্মোচিত করে দিয়েছে। ‘হিজাব আমার অধিকার’ ব্যানার নিয়ে ভারতের নানা স্থানে মুসলিম নারী ও তাঁদের সমর্থকেরা মিছিল করে চলেছেন। তাঁদের সমর্থনে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও মিছিল-মিটিং হচ্ছে। খোদ মার্কিন প্রশাসন এই ইস্যুতে তাদের রাজনৈতিক মিত্র ভারতকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে হিজাব পরিধানের অধিকার মুসলিম নারীদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তের ব্যাপার। (ভারত সরকার অবশ্য তুড়ি মেরে মার্কিন প্রতিবাদকে উড়িয়ে দিয়েছে)। ভারতের খ্যাতিমান কয়েকজন ব্যক্তিত্ব হিজাব পরিধান করা না-করার ব্যক্তিগত অধিকারকে সমর্থন জানিয়ে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছেন। ধর্মকে অন্ধভাবে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে অপব্যবহার একটি সমাজকে কতখানি গোমরাহির অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে পারে, তারই প্রত্যক্ষ উদাহরণ হয়ে উঠেছে ভারত।

২০১৪ সালে ‘গুজরাট দাঙ্গার মহারথী’ বিজেপির নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁর উগ্র মুসলিমবিরোধী অপরাজনীতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় ভারতীয় জনগণ ক্রমেই সাম্প্রদায়িকতার মহাগহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে। এখন হয়তো অনেকেই ভুলে গেছেন যে প্রায় এক দশক আগে ভারতের গোধারা নামক স্থানে একটি ট্রেনের যাত্রীরা একদল আততায়ীর অগ্নি-সন্ত্রাসের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর বিনা তদন্তে ওই ঘটনার জন্য গুজরাটের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মুসলিম সম্প্রদায়কে সরাসরি দায়ী করে টেলিভিশন-ক্যামেরার সামনে চরম উসকানিমূলক বক্তব্য রেখেছিলেন। ওই উসকানির সঙ্গে সঙ্গে গুজরাটে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছিল, যে দাঙ্গায় আনুমানিক দুই হাজার মুসলিমকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। টেলিভিশনের ক্যামেরার সামনে মোদি চোখ রাঙিয়ে বলেছিলেন, ‘এই আক্রমণের জন্য তাদের চরম মূল্য দিতেই হবে।’ এভাবে একজন মুখ্যমন্ত্রীর দাঙ্গা উসকে দেওয়ায় কংগ্রেস আমলে মোদির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হলেও ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিজেপি-নিয়োজিত বিচারপতিদের নির্লজ্জ পক্ষপাতিত্বপূর্ণ রায়ে মোদিকে অভিযোগ থেকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়েছিল। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে প্রধানত ওই উসকানিদাতার ভূমিকার জন্যই ভারতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদি একজন সর্বভারতীয় রাজনৈতিক নেতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়ে অন্যান্য নেতাকে পেছনে ফেলে দলটির প্রধান নেতার আসনে উঠে আসেন। তিনি কট্টর হিন্দুত্ববাদকে বিজেপির রাজনীতির মূল আদর্শে পরিণত করে দুই বছরের মধ্যেই লোকসভার নির্বাচনে কংগ্রেস-নেতৃত্বাধীন জোটকে হারিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পদটি দখল করে নেন। ভারতের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ যে কত ঠুনকো, সেটা বিজেপির এহেন নাটকীয় উত্থান চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। বলতে গেলে ২০০২ সালের ওই দাঙ্গার পর থেকে দুই দশক ধরে ভারতীয় রাজনীতি মোদি এবং বিজেপির হিন্দুত্ববাদের আফিমের মৌতাতে মশগুল রয়েছে। বিজেপির আদর্শিক মূল সংগঠন আরএসএসের গেরুয়া-উত্তরীয়ধারী গুন্ডারা ‘সিভিল আর্মি’র ঢংয়ে লাঠিমিছিল করে ভারতের বেশির ভাগ শহরে এখন মুসলিম সম্প্রদায়কে ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান দিতে বাধ্য করছে এবং স্লোগান দিতে অস্বীকার করলে লাঠিপেটা করে চলেছে। কর্ণাটকের এহেন একটি মিছিলের সামনে পড়ে যাওয়ায় ওই তরুণীকে আক্রমণের শিকার হতে হয়েছিল।

পাঠকদের হয়তো মনে আছে, ২০১৪ সালে যখন নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনে জিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন তাঁর বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন, কিন্তু ২০১৪-১৯ সালের পাঁচ বছরের মেয়াদে তাঁর জনপ্রিয়তায় মোটেও ভাটার টান পরিলক্ষিত হয়নি; বরং ২০১৯ সালের নির্বাচনে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি আরও বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে পুনর্নির্বাচিত হয়েছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে বিজেপি তাদের কট্টর হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডাকে কোনো রাখঢাক ছাড়াই সামনে নিয়ে এসেছে। নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মোদি সরকার একের পর এক এই হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়িত করে চলেছে; যার মধ্যে ভারতীয় সংবিধানে প্রদত্ত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদার বিলোপ, ন্যাশনাল রেজিস্টার অব সিটিজেনশিপ (এনআরসি) আইন পাস এবং সর্বশেষ সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) পাস গোটা ভারতে এবং বিশ্বেও প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ভারতে ওই সময় বড় বড় নগরীর রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছে সিএএ পাসের বিরুদ্ধে লাখ লাখ প্রতিবাদকারীর মিছিলে-স্লোগানে, যাতে নিহত হয়েছে প্রায় ২০ জন মানুষ।

সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে যেভাবে মুসলিমদের বাদ দিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশকারী অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের ভারতীয় নাগরিক হওয়ার বিশেষ সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তা যে চরম বৈষম্যমূলক ও অগ্রহণযোগ্য সাম্প্রদায়িকতা, সেটা খোদ জাতিসংঘকেও ঘোষণা করতে হয়েছিল। কিন্তু মোদি পুরোপুরি নির্বিকার। কারণ, মোদি বুঝতে পেরেছেন, কট্টর হিন্দুত্ববাদী চরম-দক্ষিণপন্থী রাজনীতির আফিম এখন ভারতীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশকে প্রবলভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। অতএব আগামী কয়েক বছরের নির্বাচনে বিজেপির বিজয়ের সম্ভাবনা এই আফিমের মৌতাতে বাড়বে বৈ কমবে না। ভারতে সাধারণ হিন্দু জনগণের মুসলিমবিদ্বেষকে সুপরিকল্পিতভাবে উসকে দিয়ে নরেন্দ্র মোদি ভারতের নব্য জনগণমন অধিনায়ক বনে গেছেন।

অন্যদিকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি নেতাদের বেলাগাম গলাবাজি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ তাঁর কথিত অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের অর্থনীতি ও সমাজকে ‘উইপোকার’ মতো কুরে কুরে খাচ্ছে বলে যত্রতত্র গালমন্দ করে বেড়াচ্ছেন। অবশ্য পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনে অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী ইস্যুটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে অত্যন্ত খারাপভাবে ধরা খেয়ে গেছেন নরেন্দ্র মোদি, বিজেপি নির্বাচনে গোহারা হেরে গেছে। কিন্তু এর আগে আসামে অবৈধ বাংলাদেশিদের লাথি মেরে বঙ্গোপসাগরে ফেলে দেওয়ার প্রোপাগান্ডা ঠিকই বিজেপিকে নির্বাচনী বিজয় এনে দিয়েছিল। ত্রিপুরায়ও সিপিএমকে হারিয়ে বিজেপি ক্ষমতাসীন হয়েছে। ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানানোর জন্য মোদি এবং তাঁর চেলা-চামুণ্ডারা ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের ইতিহাস পর্যন্ত বদলে দিচ্ছেন, যেখানে মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু এবং কংগ্রেসের পরিবর্তে সাভারকার এবং বল্লভভাই প্যাটেলকে ‘প্রকৃত হিরো’ বানানোর প্রয়াস সামনে চলে এসেছে।

মোদির কট্টর মুসলিম-বিরোধিতা ক্রমেই সারা বিশ্বে মুসলিম সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোকে চাঙা করে তুলছে; বিশেষ করে ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের তাণ্ডব বাড়ার প্রবল প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে ভারতের ঐতিহাসিক ভূমিকার কারণে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যেহেতু পারতপক্ষে ভারতবিরোধী অবস্থান নেয় না, তাই জনগণের একটি ক্রমবর্ধমান অংশ আওয়ামীবিরোধী, ভারতবিরোধী ও পাকিস্তানপন্থী বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। ২০২১ সালের মার্চে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসবে যোগ দিতে বাংলাদেশ সফরে আসাকে উপলক্ষ করে হেফাজতে ইসলামের লেবাসধারী সাম্প্রদায়িক ও ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংস আক্রমণ চালিয়ে বেধড়ক ভাঙচুর চালায় এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোর প্রয়াস পায়।

পুলিশ ও র‍্যাব তাদের দমনে বেশ কয়েক স্থানে গুলি চালালে ১২ জন দাঙ্গাকারীর প্রাণহানি ঘটে। এর কিছুদিন পর কুমিল্লায় দুর্গাপূজার মণ্ডপে রাতের আঁধারে হনুমানের মূর্তির কোলে পবিত্র কোরআন শরিফ রেখে আসার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে ওই মণ্ডপে ভাঙচুর হয়। একে কেন্দ্র করে কয়েক দিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মন্দির ভাঙচুর এবং হিন্দুদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে লুটপাট চলে। অতএব স্বীকার করতেই হবে, ২০১৪ সাল থেকে মোদি এবং বিজেপি ভারতে তাদের কট্টর হিন্দুত্ববাদী অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষের রাজনৈতিক শক্তি আওয়ামী লীগ ও প্রগতিশীল দলগুলোর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে, যা দেশের রাজনীতিতে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

ড. মইনুল ইসলাম: অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ