গতকাল সোমবার জাহীদ রেজা নূর আজকের পত্রিকায় ‘রাশিয়া আর চীন, সম্মেলনের পরে’ নামে একটি উপসম্পাদকীয় লিখেছেন। সে লেখায় এসসিও সম্মেলনের রাজনৈতিক বিষয়গুলো ভালোভাবে উঠে এসেছে। তবে এর অর্থনৈতিক দিকটি নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার।
সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিও সম্মেলনের পরে বোঝা যাচ্ছে, ডলারের একচেটিয়া আধিপত্য সংকুচিত হতে চলেছে। রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইরানসহ যে ১৪টি দেশ এই বলয়ের অন্তর্ভুক্ত, তাদের প্রধানতম একটি শক্তি আছে—তা হলো, পৃথিবীর জনশক্তির অর্ধেকের বেশি এই দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। এখানে এ কথাটা বললেই শেষ হবে না। আরও বলতে হয়, পৃথিবীর শিল্পের কাঁচামালসংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে ৫০ ভাগের বেশি
এদের মধ্যে সীমাবদ্ধ।
আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব এসব দেশের প্রাকৃতিক খনিজ ও অন্যান্য কাঁচামাল নিয়ে তাদের শিল্পের প্রসার ঘটিয়েছে।
এখানে একটু বলে রাখা ভালো, এই জোটের বলয়ের কাছাকাছি চলে এসেছে তুরস্ক, আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান। হাঙ্গেরি ইতিমধ্যেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোকে পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে, তারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেকোনো অবরোধের বিপক্ষে। চেক প্রজাতন্ত্রে বড় ধরনের জনবিক্ষোভ হয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবরোধের জন্য। এসব আলামত থেকে বোঝা যায় অচিরেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর মধ্যে বড় ধরনের অসন্তোষ ও আন্তসম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। পৃথিবী অবাক হবে না, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নে ভাঙন দেখা দেয়। অসন্তোষ ও ভাঙনের আলামত ইতিমধ্যেই সুস্পষ্ট হয়েছে।
এসসিও জোটের রাজনৈতিক তৎপরতার গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, এই জোটের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক একটি বিরাট প্রেক্ষাপটও আছে। প্রথমেই আসা যাক বাণিজ্যিক দিকের ব্যাপারে। রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে, তাদের দেশ থেকে গ্যাস ও জ্বালানি তেল আমদানি করতে হলে রুবলে ঋণপত্র খুলতে হবে; অর্থাৎ রাশিয়ার স্থানীয় মুদ্রায় পণ্যের মূল্য পরিশোধ করতে হবে। ইতিমধ্যেই ভারত, পাকিস্তান, চীনসহ কয়েকটি দেশ রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রুবলে ঋণপত্র আদান-প্রদান শুরু করেছে।
এখানে আরও উল্লেখ করার মতো একটা ব্যাপার ঘটে গেল গত সপ্তাহে। চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কেউ কেউ আবার উহানে ঋণপত্র খুলেছে; অর্থাৎ চীনা মুদ্রাও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একটা নিয়ামক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।
ভারতের সঙ্গে লাদাখ সীমান্ত নিয়ে চীনের যে বিরোধ চলে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে, কিছুদিন আগে মনে হয় এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে। উভয় দেশে নিজেদের সীমানার মধ্যেই নিজ দেশের সৈন্যকে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সঙ্গে অবস্থান করতে বলা হয়েছে। এর থেকে বোঝা যায়, ভারত ও চীন ভৌগোলিক সমস্যা মিটিয়ে বাণিজ্যিক দিকে বেশি মনোযোগী হবে।
এখন প্রশ্ন, এসসিও জোটের দেশগুলো, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উজবেকিস্তানসহ আরও যেগুলো আছে, বৃহৎ আকারে তুরস্ক, আর্মেনিয়া, ইরানসহ অন্যান্য দেশ তাদের দেশজ উৎপাদন ও চাহিদা নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক বাণিজ্য ও উৎপাদন দিয়ে মেটানো সম্ভব কি না? চোখ বন্ধ করে এক কথায় বলা যায়, সম্ভব।
পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি জনঘনত্বের জোটে আছে শিল্পে অগ্রসরমাণ দেশ চীন। চীনে ছোট, মাঝারি ও ভারী শিল্পের ইতিমধ্যেই প্রসার ঘটেছে। এই শিল্প সচল রাখার জন্য যে জ্বালানির প্রয়োজন, সেই জ্বালানি রাশিয়া থেকে চীন নিজস্ব স্থানীয় মুদ্রার বিনিময়ে আমদানি করছে। বিশ্বের যত কাঁচামাল দরকার, মোটামুটি বলা যায় তার সিংহভাগের মজুত আছে রাশিয়ায়। রাশিয়া যদি এই কাঁচামাল চীন ও ভারতের কাছে বিক্রি আরম্ভ করে, তাহলে নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের এক বিরাট সম্প্রসারণ ঘটবে।
রাশিয়ার দরকার বস্ত্র ও ইলেকট্রনিক সামগ্রী। এসব নিত্যপণ্য ভারত ও চীন উৎপাদন করে, উজবেকিস্তান, পাকিস্তান, ইরানসহ অন্যান্য দেশে প্রচুর তুলা উৎপাদন হয়, অর্থাৎ বস্ত্রশিল্পের কাঁচামাল এই গোষ্ঠীর নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান।
মোদ্দাকথা, বলতে চাইছি যদি এই বলয়ের দেশগুলো, নিজেদের মধ্যে বাণিজ্য সম্প্রসারণ, শিল্পের বিকাশ ও নিত্যপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোসহ পরস্পরের মধ্যে একটি সম্প্রসারিত বাণিজ্যনীতি চালু করে, তাহলে পশ্চিমাদের মুখাপেক্ষী আর হতে হবে না। পশ্চিমাদের মুখাপেক্ষী হতে না হলে ডলারের খুব একটা বেশি দরকার পড়বে না। আর পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি মানুষ যদি ডলার মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেদের মধ্যে আন্তদেশীয় মুদ্রার বিনিময়ে বাণিজ্য আরম্ভ করে, তাহলে দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে ডলারের আধিপত্য সংকুচিত হয়ে ৫০ ভাগের নিচে চলে যাবে। এ ক্ষেত্রে শুধু বাণিজ্যঘাটতি নিজেদের মধ্যে ২০ শতাংশের বেশি যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালো, সামরিক ভারী শিল্পের জন্য রাশিয়া এখনো অদ্বিতীয়। উল্লিখিত দেশগুলোর সামরিক নিরাপত্তার জন্য যেকোনো দেশ রাশিয়ার ওপর নির্দ্বিধায় নির্ভর করতে পারবে, আগে পরীক্ষিত হয়েছে যে রাশিয়া কারও বিপদের সময় দূরে ঠেলে দেয় না।
ওপরের সামান্য আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, রাশিয়া, চীন, ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য ১৪টি দেশের জোটের মধ্যে আছে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাঁচামাল, ছোট শিল্প থেকে ভারী শিল্প, ভারী সমরাস্ত্র শিল্প, যোগাযোগব্যবস্থা—সর্বোপরি এই দেশগুলোর মধ্যে ডলারভীতি ও স্থানীয় মুদ্রাকে সম্প্রসারণ ও মূল্যায়িত করার অসাধারণ একটি স্পৃহা; যা এ দেশগুলোকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে।
এই জোটের সম্প্রসারণ আরম্ভ হলে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ যেমন সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরবসহ বেশ কিছু দেশ এই জোটের সঙ্গে বাণিজ্য সম্প্রসারণ করবে। অদূর ভবিষ্যতে যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাঁচ থেকে ছয়টি দেশ এসসিও জোটের সঙ্গে একত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটায়, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
পৃথিবী মনে হয় অচিরেই এককেন্দ্রিক ডলারের বলয়মুক্ত হয়ে, অন্য একটি বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক বলয়ের দিকে জোট বাঁধতে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে এককেন্দ্রিক আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের বিপরীতে আরও একটি রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক জোট পৃথিবীর মানচিত্রে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। এখন শুধু কয়েকটা দিনের অপেক্ষা মাত্র।
আমরা সাধারণ মানুষ আশা করব, পৃথিবী যেন হয় তাঁবেদারমুক্ত, মোড়লিপনামুক্ত, মুক্তবাণিজ্য, মুক্ত অর্থনীতি, মুক্তমনে চলাফেরা করা সবার অধিকারের নিশ্চয়তার।
শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি হলে, এককেন্দ্রিক শক্তির পৃথিবী থেকে বেরিয়ে আসতে পারলে, সেটা অবশ্যই সবার জন্য মঙ্গল হবে।
লেখক: প্রকৌশলী