রশীদ করীম একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেই সাক্ষাৎকার ছাপা হওয়ার পর দেখা গেল, সম্পাদনার ঠেলায় তিনি যা বলতে চেয়েছেন, তার গুরুত্বপূর্ণ অংশই বাদ পড়ে গেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেখানে তিনি বাংলাদেশে সাহিত্যের মূল্যায়ন ও সাহিত্যিক খ্যাতির বিষয়টি তুলে এনেছেন। নির্মোহ সাহিত্য আলোচনার চেয়ে কোনো একদিকে ঝুঁকে আলোচনা করার একটা স্বভাব দাঁড়িয়ে গেছে।
তিনি বলেছিলেন, কোনো কোনো লেখকের লবি আছে। তাঁদের প্রশংসা করার জন্য একদল লোক তৈরি থাকে। শুধু লোক নয়, সাপ্তাহিক পত্রিকা আর সংবাদপত্রের সাময়িকীও একই কাজ করে। সেই নির্দিষ্ট কিছু লেখক কারণে-অকারণে তাঁদের কাছ থেকে প্রশংসা পেতে থাকেন। তাঁদেরই কেউ কেউ লেখকদের সার্টিফিকেট দেন, যেন তাঁদের এই প্রশংসার ওপরই নির্ভর করছে লেখকের উত্থান। আবার কারও লেখার তুমুল সমালোচনা করেন, যেন সেই লেখকের কোনো ভবিষ্যৎ নেই, পতনই তাঁর একমাত্র গন্তব্য।
টেলিভিশনেরও একই রোগ পেয়েছে। চেনা মুখদের নাটক তারা গ্রহণ করে, পরিবেশন করে। চেনা লেখকদের আনে আলোচনা সভায় এবং সেখানে যে আলোচনা হয়, সেগুলো চেনা লোক ছাড়া আর কারও পক্ষে করা সম্ভব নয়।
পরস্পর পিঠ চুলকানি সমিতি সে সময়েও ছিল, এখনো আছে। তবে রশীদ করীম তাঁর প্রবন্ধের একেবারে শেষে যে কথা বলেছেন, সেটা আমাদের সাহিত্য সমালোচনাকে একেবারে উলঙ্গ করে ছেড়েছে।
একবার এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সাহিত্য আলোচনা হচ্ছিল। সেখানে একজন লেখক ও একজন লেখিকা ছিলেন আলোচক। আলোচনা শুরু হলে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ আর শওকত ওসমানকে নিয়ে কথা হলো। তাঁদের দুজনের লেখালেখির প্রশংসা হলো এবং এরপর যাঁদের ওপর প্রশংসা বর্ষিত হলো, তাঁরা আর কেউ নন, স্টুডিওতে উপস্থিত দুই লেখক-লেখিকা। লেখক প্রশংসা করছেন লেখিকার লেখার, লেখিকা প্রশংসা করছেন লেখকের লেখার।
রশীদ করীম এটুকু বলেই ছেড়ে দিয়েছেন।
সূত্র: সৈয়দ শামসুল হক, হৃৎকলমের টানে, পৃষ্ঠা ২৯৯-৩০০