হোম > ছাপা সংস্করণ

জীবনের মূল্য ও অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা

মামুনুর রশীদ

সেদিন লিফটে করে উঠছিলাম, একটি শিশুও ছিল লিফটে। লিফটি খুব দ্রতই ভরে গেল এবং অতিরিক্ত কিছু মানুষও উঠে গেল সেখানে। শিশুটি ভয় পাচ্ছিল, আমিও ভয় পাচ্ছিলাম। হয়তো আমার মতো শিশুটিরও লিফটে আটকে যাওয়ার বা লিফটি হঠাৎ করে নিচে পড়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। শিশুটির সঙ্গে সঙ্গে আমিও বলছিলাম, ভয় পাচ্ছি। কিন্তু অবুঝ আরোহীরা কিছুই বুঝতে চেষ্টা করল না। এ ভয় দ্রুতগামী বাসে হয়, ট্রেনে হয়, বড় বড় লঞ্চেও হয়। মাত্রাতিরিক্ত যাত্রী উঠে পড়ে। লঞ্চটি ঝড়ের কবলে পড়লে ভয়টা আরও বাড়ে। কারণ লঞ্চগুলো এখনো অদক্ষ চালক দ্বারা পরিচালিত। একবার টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন যাচ্ছিলাম কাঠের নৌকায়। বড় বড় ঢেউ দেখে ভয়ও পাচ্ছিলাম। কিন্তু চালক একাই হালটা ধরে পরম নিশ্চিন্তে বিড়ি খেতে খেতে যন্ত্রচালিত নৌকাটি চালিয়ে যাচ্ছিলেন নির্ভয়ে।

আমি তাঁর পাশে গিয়ে বসলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, এত বড় বড় ঢেউ নৌকাটা ডুবে যাবে না তো। তিনি হাসলেন এবং পরমুহূর্তেই বিড়িতে জোরে একটা টান দিয়ে বললেন, ‘ন ডরাইয়েন, ইবা তুফান তো উডে ন।’ স্পষ্ট বুঝলাম আমার মতো একজন ভিতু যাত্রী তাঁর মনে কৌতুকের উদ্রেক করেছে। যাহোক সে যাত্রায় সেন্ট মার্টিন থেকে নিরাপদেই ফিরে এসেছিলাম। একটা সময় ছিল যখন ঢাকা-টাঙ্গাইলের রাস্তা খুবই অপ্রশস্ত, তখন দুর্ঘটনা ঘটা ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। রাস্তা প্রশস্ত হওয়ার পরও দেখেছি ট্রাক উল্টে আছে, বাস ভেঙে চুরমার হয়ে খাদে পড়ে আছে। রাস্তায় রক্ত জমাট বেঁধে আছে।

প্লেনে উঠেও স্বস্তি নেই, ঠিকমতো আকাশে ওঠানামা, চাকাটি অক্ষত থাকা—এসব শঙ্কা লেগেই থাকত। স্বাধীনতার গত পঞ্চাশ বছরে আমরা সড়কপথ, নদীপথ, রেলপথ ও আকাশপথকে বিপন্মুক্ত করতে পারিনি। যত লোক মহামারিতে মারা যায়, তার চেয়ে বেশি লোক মারা যায় দুর্ঘটনায়। লিফট ছিঁড়ে, লিফটে আগুন ধরে মানুষ মারা যায়। বাবার কোলে শিশুটি কী নিষ্ঠুরভাবে মারা গেল, সে কথা মনে হলে গা শিউরে ওঠে। একবার কোনো এক বিপণিবিতানের লিফটে উঠেছি, মাঝপথে লিফট আটকে গেছে। আমরা হলুদ বোতাম টিপছি, কিন্তু কেউ সাড়া দিচ্ছে না। জানা গেল, লিফটের দায়িত্বে যিনি আছেন, তিনি কোথাও গেছেন; আসতে দেরি হবে। ভেতরে গাদাগাদি করা মানুষ। একজন আরেকজনের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। অনেকক্ষণ আটকে থাকার পর লিফটে ভেতরের কোনো অভিজ্ঞ যাত্রীর সহায়তায় আমরা বের হলাম। কাজেই ওই লিফটে আমার এবং ওই শিশুটির ভয় অমূলক নয়। কেন এ রকম হয়? যাঁরা চালক তাঁদের অদক্ষতা? নাকি তাঁদের সততার অভাব? এসব অভাব তো আছেই, তার ওপরে আছে জীবনের মূল্যটি বোঝার।

ট্রিপ সিস্টেমে যাঁরা গাড়ি চালান, তাঁদের জীবনে কোনো দিন-রাত নেই। সকালবেলায় ট্রিপ নিয়ে দিনাজপুর গিয়ে দুই ঘণ্টা পরে আবার ঢাকায় ফিরে আসেন। মাঝখানে খাওয়ার বিরতি। প্রচুর ভূরিভোজন করার পর চালকের আসে ঘুম। ওই ঘুম চোখে নিয়েই তিনি আবার যাত্রা করেন। গাড়ির চল্লিশ-পঞ্চাশজন যাত্রী এবং তাঁর নিজের জীবনের মূল্য তিনি ভুলে যান। পথে দুর্ঘটনায় পতিত হলো গাড়ি। যাত্রীদের জীবন গেল, সেই সঙ্গে নিজের জীবনটাও। নিহত যাত্রীদের আত্মীয়-স্বজনের কান্নায় আকাশ ভেঙে পড়ে; সেই সঙ্গে তাঁর স্ত্রী-কন্যারাও অসহায় হয়ে পথে পথে ঘুরে বেড়ায়। লাখো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল। জীবন যে কত অমূল্য, আমরা তখন বুঝেছি। কিন্তু পরবর্তীকালে আমরা এই মূল্যকে বুঝতে চাইনি। ঈদে বা কোনো ছুটির সময় কোথাও যেতে হয়, এটা প্রয়োজন। কখনো খুব জরুরিও। তাই বলে জীবনের মূল্যটা মানুষ বুঝবে না? লঞ্চে বা স্টিমারে অনেকটা নিরাপদবোধ করেছি। একমাত্র চাঁদপুরের পরে পদ্মা-মেঘনার সঙ্গমস্থল ছাড়া। সেখানেও অনেক লঞ্চডুবি হয়েছে। পানির এত শক্তি যে বিশাল বার্জকে এমনভাবে ডুবিয়েছে, পরে ডুবুরিরা তার ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাননি।

টাইটানিক যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা এই সত্য বারবার উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু এবারে সুগন্ধা নদীতে যা ঘটল, তা সত্যি বিরল। আগুন-পানির যৌথ আক্রমণে শতাধিক প্রাণ শেষ হয়ে গেল। আগুনে দগ্ধ হওয়ার ফলে যাঁরা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছেন, তাঁদেরও সলিলসমাধি হলো। প্রায় আট শ জন যাত্রীবাহী লঞ্চটিতে অগ্নিনির্বাপণের কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো বয়ার ব্যবস্থা। আর এই সব লঞ্চে কোনো দক্ষ ফায়ার ফাইটার থাকে না এবং যেকোনো জরুরি অবস্থা মোকাবিলার কোনো কর্মীও এখানে থাকে না। মানুষ শুধু আল্লাহর ওপর ভরসা করে লঞ্চে উঠে যায়। প্রতিদিন শতসহস্র লঞ্চ নদীপথে চলাচল করে। বিপদ-আপদ প্রতিদিন হয় না; কিন্তু যখন হয়, তখন ভয়ংকরভাবে হয়। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে গেলে হাজার হাজার যাত্রীকে দেখা যায় পরম নিশ্চিন্তে লঞ্চে গিয়ে উঠছে। অভিযান-১০ লঞ্চটিতেও এমনি হুড়োহুড়ি করে লঞ্চে উঠেছিল আট শ আদম সন্তান। শীতের রাত্রি, দারুণ ঠান্ডায় গুটিশুটি মেরে যাত্রীরা শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল।

লঞ্চের ইঞ্জিনে ত্রুটি, চালক অনুমানই করতে পারেননি। ইঞ্জিন গরম হয়ে যাচ্ছে, লঞ্চটি উত্তপ্ত হয়ে যাচ্ছে, চালক লঞ্চের গতি আরও বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে অদক্ষ চালকের হাতে পড়ে বহু মূল্যবান জীবন শেষ হয়ে গেল। সব পরিবহনের শ্রমিকেরাই সাধারণত দরিদ্র। তাঁদের অর্থের প্রয়োজন অপরিসীম। ন্যায় ও অন্যায়ের পথে তাঁরা অর্থ উপার্জন করে থাকেন। সেই সঙ্গে আছেন তাঁদের নির্দয়, মালিক ও নেতারা। এখানে শ্রমিকের প্রতিবাদের কোনো সুযোগ নেই। নেতারা দানবের মতো শ্রমিকদের পীড়ন করেন আর মালিকের চাই মুনাফা। এর মধ্য দিয়ে জীবনের মূল্যটি বোঝার সুযোগ কোথায়? জীবনযাপনের যে একটা সংস্কৃতি আছে, সেটা শিক্ষা দেবে কে?

মেরিন একাডেমিতে দীর্ঘদিন লেখাপড়া, অনুশীলন, পরীক্ষা শেষে একজন শিক্ষানবিশ থেকে জাহাজের ক্যাপ্টেন বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সুযোগ পায় আর দেশের ভেতর আমাদের নদীগুলোতে যাঁরা নৌযান চালান, তাঁদের প্রশিক্ষণের সুযোগ কোথায়? জাহাজের ক্যাপ্টেনরা একটা সাংস্কৃতিক জীবনযাপন করেন, খালাসিরাও সেই সুযোগ পান। তাঁরা সিনেমা দেখেন, গান শোনেন, কেউ কেউ বাঁশি বাজান। দেশের বিখ্যাত উচ্চাঙ্গের বংশীবাদন শিল্পী আজিজুল ইসলাম জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন। কী নম্র, কী ভদ্র, কী শিক্ষিত মানুষ তিনি। অনেক নাবিকের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। যাঁরা ভ্রমণকাহিনি লিখেছেন এবং মহাসমুদ্রের রহস্যকে দেখে দেখে তাঁরা জীবনের বিপৎসংকুল পথকে অতিক্রম করেছেন। তাঁরা উপলব্ধি করেছেন, জীবনের মূল্য কী। আমাদের দেশে পরিবহন শ্রমিকেরা সবাই রাজনীতিবিদ। তাঁরা বিপুল অর্থের মালিক। সরকারের সঙ্গে দেনদরবার, যাত্রীদের হয়রানি, অদক্ষ চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার কাজে তাঁরা খুবই দক্ষ। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের জীবনের মূল্য দায়িত্বশীল করা, সুন্দর জীবনাচরণ এবং সাংস্কৃতিক শিক্ষা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কোনো দিন তাঁরা উপলব্ধি করেননি। কিছু কিছু পরিবহন নেতা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, কেউ বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; কিন্তু জীবনবোধ, মানবিকতাবোধ এতটুকু উপলব্ধি করেননি। এমনি করে গড্ডলিকা প্রবাহ চলেছেবছরের পর বছর।

স্বাধীন দেশের দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েও গত পঞ্চাশ বছরে তাঁরা ন্যূনতম মানবিক মূল্যবোধের কথা ভাবেননি; বরং আইনকে অমান্য করার সব পন্থার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। এ কথা আমি বিশ্বাস করব না যে, দেশে নৌপথ, সড়কপথের জন্য কোনো আইন নেই; কিন্তু সেই আইনের প্রয়োগ এক গভীর জটিলতায় নিমগ্ন। আইনগুলো ভাঙার ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও জড়িত। সরকারও মাঝে মাঝে তার দলের লোকদের আইন ভাঙতে সাহায্য করে। বিচারব্যবস্থা এক ঢিমেতালে চলতে থাকে। বিচারের বাণী তাই নীরবে নিভৃতে গুমরে গুমরে কাঁদে। বিবাদী ছাড়া পেয়ে যায়, অসহায় বাদী নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।

আজকাল প্রায়ই শোনা যায়, স্বয়ং ক্ষমতাসীন রাজনীতিকেরাও বলেন, রাষ্ট্রটাকে আমরা মানবিক করতে পারিনি। কীভাবে মানবিক হবে, সেটি এখনো ভাবনার বাইরে। একটি ঘটনা উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করব। একবার লালমনিরহাট থেকে একটি ট্রেন উত্তরবঙ্গের উদ্দেশে যাচ্ছিল। দেখা গেল ট্রেনটি কয়েকটি স্টেশনে থামছে না; অথচ সেখানে থামার কথা ছিল। আবিষ্কার করা গেল ট্রেনের চালক নেই। লালমনিরহাটে নেমে চালক বোধ হয় রসগোল্লা খাচ্ছিলেন। এর মধ্যে ট্রেনটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলছিল। যাত্রীরা বোঝার পর কান্নাকাটি, আর্তনাদ শুরু করল। আর এদিকে রেল কর্তৃপক্ষ একের পর এক সিগন্যাল ছেড়ে দিল। পরে একজন সাহসী চালক ট্রেনের ছাদে উঠে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইঞ্জিনরুমে প্রবেশ করে ট্রেনটি থামানোর ব্যবস্থা করেন। দায়িত্বহীন চালকের হাতে পড়ে এতগুলো জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল। আমরাও কি তেমনি এমন এক চালকের যানবাহনে বসে আছি? এক অনিশ্চিত গন্তব্যের দিকে? যে চালক কারও জীবনের মূল্যই বোঝে না।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শেষ সাক্ষীর জেরা চলছে

ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ পাওয়ার আশায় সাগরে জেলেরা

ভারতের নিষেধাজ্ঞা: স্থলবন্দর থেকে ফেরত আসছে রপ্তানি পণ্য

নিলামে গৌতম বুদ্ধের রত্নসম্ভার

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সমালোচনা জাতিসংঘের উদ্বেগ

ভারতের হামলা, পাকিস্তানের প্রস্তুতি

মহাসড়কে ডাকাতি, লক্ষ্য প্রবাসীরা

বিআরটি লেনে বেসরকারি বাস

হইহুল্লোড় থেমে গেল আর্তচিৎকারে

সন্দ্বীপ সুরক্ষা প্রকল্প: এক বছরেও শুরু হয়নি কাজ