বাড়ি বদল করলেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। উঠলেন ব্রহ্মপুরের ভাড়াবাড়িতে। বিশাল দোতলা বাড়ি। ওপরতলা বন্ধ থাকত, নিচের তলায় ড্যারা গড়ে তুলল শ্যামলপরিবার। বাড়িটি ছিল খুব ভালো, কিন্তু সমস্যা ছিল একটা—বিশাল সাইজের একেকটা মশা সেখানে রাজত্ব করত। এবং তা একটা-দুটো নয়, অজস্র।
মশার উপদ্রবে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখালেখি, খাওয়াদাওয়া, ঘুম—সবকিছুই বন্ধ হওয়ার জোগাড়।
নিজেকে শ্যামল নাম দিয়েছিলেন ‘অসাধ্যসাধন গাঙ্গুলি’। এবারও অসাধ্যসাধন করে ছাড়লেন তিনি। একদিন বিশাল এক মশারি নিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। ইতি গঙ্গোপাধ্যায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘এত বড় মশারি! কোথায় পেলে?’ শ্যামল বললেন, ‘বানালাম।’ এরপর সেই মশারি টানালেন। এ এক অদ্ভুত মশারি। শুধু খাটে নয়, গোটা ঘরজুড়েই পাতা হলো সেই মশারি। মশারির ভেতরে ঢুকে গেল চেয়ার-টেবিল। সেখানেই লেখালেখি, সেখানেই বসবাস। মশার কি আর সাধ্য আছে এই মশারির ভেতরে ঢোকে!
এই মশারির ভেতরে বসেই লেখা হয়েছিল শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের অমর কীর্তি ‘শাহজাদা দারাশুকো’। সেই শাহজাদা দারাশুকো নিয়ে একবার বক্তৃতা করতে গিয়ে রসিকতা করে শ্যামল বলেছিলেন, ‘আমি টুকে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম শাহজাদা দারাশুকো—সেইটা বেরোবার পর বহু ইতিহাসের পণ্ডিত সমঝে নিয়েছেন যে আমি ভয়াবহ পণ্ডিত। কিন্তু তাঁরা জানেন না যে পাশের বাড়ির একটা ক্লাস টেনের মেয়ের কাছ থেকে নাইন-টেনের ‘স্বদেশ ও সভ্যতা’ বইটি নিয়ে সামনে রেখে লেখা।’
এই কৌতুককে অনেকেই সত্য বলে ধরে নিয়েছিল। কিন্তু আসলে বইটি লেখার সময় বাড়ি ভরে গিয়েছিল উপন্যাসটি লেখার জন্য প্রয়োজনীয় বইয়ে। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন শ্যামল। বাড়িতে ইতিহাসবিদ, পণ্ডিত ও অধ্যাপকদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে বইটি লেখার ক্ষেত্রে খুব সাহায্য করেছেন। তার পরও বলতে হয়, এই অসাধারণ নজিরবিহীন মশারিটা না থাকলে ‘শাহজাদা দারাশুকো’ লেখা হতো না।
সূত্র: ইতি গঙ্গোপাধ্যায়, শাহজাদা দারাশুকো, পৃষ্ঠা ৮৭-৮৯