সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘মুসাফির’ থেকে
‘প্লেন যখন ইংলিশ চ্যানেলের ওপর দিয়ে যাচ্ছে, তখন ছোকরা মুখুজ্যে শুধালে, ‘চাচা, লন্ডনে গিয়ে উঠব কোথায়, চিন্তা করেছেন কি?’
আমি বললুম, ‘বাবাজি, কিচ্ছুটি ভাবতে হবে না। হাটে গিয়ে চাল-ডাল কিনে নিয়ে আসবে; আমি ততক্ষণে বটগাছতলায় ইটের উনুন জ্বালিয়ে রাখব। শুনেছি লন্ডনের ওপর বিস্তর বোমা পড়েছিল, ইট পেতে অসুবিধে হবে না।’
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে বিস্তর খোঁজাখুঁজির পরও যখন বটগাছ পাওয়া গেল না, তখন বাধ্য হয়ে হোটেলে উঠতে হলো।’
বটতলায় হোক বা রান্নাঘরেই হোক, প্রয়োজনীয় মালমসলা পেলেই যে আমাদের ছোটচাচা সৈয়দ মুজতবা আলী অতি উত্তম রান্না করে অবাক করে দিতে পারতেন, সে খবরটি কিন্তু অনেকেরই অজানা।
আমি চাচার এ গুণটির কথা আগেই জানতাম। তবে কয়েক দিন আগে আমার চাচাতো ভাই ফিরোজের কাছে আবার নতুন করে জেনে নিলাম।
ফিরোজ ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ বছর তিনেক চাচার সঙ্গে শান্তিনিকেতনে ছিল। তখন সে ওখানে ক্লাস সেভেন পর্যন্ত পড়াশোনা করে পরে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে ক্লাস এইটে ভর্তি হয়।
ফিরোজের শান্তিনিকেতন থাকাকালে চাচা প্রায়ই বিভিন্ন রকম রান্না তৈরি করে তাকে খাওয়াতেন। সেই সব স্মৃতি রোমন্থন করে ফিরোজ এখনো আনন্দে ভাসে।
সৈয়দ মুজতবা আলী যে শুধু বিভিন্ন রান্নার রেসিপি জানতেন, তা নয়; বহুপদের ইতিহাসও তাঁর খুব আয়ত্তে ছিল।
আমাদের প্রিয় মাংসের ঝোল কী করে হাঙ্গেরিতে গিয়ে গুলাশ হয়ে গেল অথবা ইতালিয়ানদের প্রিয় কুজিন রিসাত্তো আমাদের প্রিয় কোপ্তা পোলাওয়ের ফার্স্ট কাজিন, সেই বৃত্তান্ত উনি পঞ্চতন্ত্র বইয়ের আহারাদি পর্বে বিস্তারিতভাবে জানিয়ে দিয়ে গেছেন।
সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, রান্না হচ্ছে একটা পুরোদস্তুর আর্ট আর যাঁরা এই আর্টটা পুরোপুরি আয়ত্ত করতে পেরেছেন, তাঁরাই হচ্ছেন রান্নাশাস্ত্রে আর্টিস্ট।
আর ছোটচাচা আরও বলেছেন, ওনার নিজের দেখা সেরা রান্নার আর্টিস্ট হচ্ছেন আমাদের দাদিজান আমাতুল মন্নান খাতুন চৌধুরী।
ফ্রাইড রাইস মানে ভাজা উকুন!
চাচা রসিকতাচ্ছলে বলতেন, ভুলেও কখনো চাইনিজ খেয়ো না।
কেন, অসুবিধা কী?
ওরা তোমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে ভাজা উকুন খাইয়ে দেবে।
সর্বনাশ, সেকি! কত দিন চাইনিজ খেয়েছি। টের পাইনি তো!
তাহলে শোনো, চীনারা তো ‘র’কে ‘ল’ বলে, তাই রাইসকে লাইস বলে। আর লাইস মানে তো উকুন, তাহলে ওদের ফ্রাইড লাইস, মানে তো ভাজা উকুনই হলো।
হলো কি না, জানি না; তবে ঈদ উপলক্ষে যাঁরা চাইনিজ রান্না-বান্না করবেন, তাঁদের আমি অনুরোধ করব এ নিয়ে বেশি চিন্তাভাবনা করে ঈদের আনন্দ মাটি করবেন না। যা মনে হয় রান্না করে ফেলুন। খাওয়ার সময় এমনিতেই সবাই বলবে ফ্রাইড রাইস হয়েছে না ভাজা উকুন হয়েছে।
সবাই ভালো থাকুন।
ঈদের শুভেচ্ছা রইল।
তথ্যসূত্র: মুসাফির-লেখক সৈয়দ মুজতবা আলী।
ঋণস্বীকার: সৈয়দ মোশাররফ আলী (ফিরোজ)।